চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নের আজমতপুর গ্রামের তাইফুর রহমান ও পারভিন আখতারের ছেলে শিশু জিহাদ হাসান। দেশের সর্ব পশ্চিম-উত্তর সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম আজমতপুর। মাত্র ১ কিলোমিটার দুরেই ভারত। নেই তেমন কোন নাগরিক সুবিধা। আর্থিক সংকট এবং প্রতিবন্ধি হওয়ায় প্রতিবেশিদের তাচ্ছিল্যতা এমনকি নিজ জন্মদাতা পিতারও অবহেলায় অজপাড়াগায়ে জ¦লে ওঠা এক শিশু জিহাদ হাসান। ২টি সন্তানের পর তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্মের পর থেকেই ছিলনা তার ২ হাতের কোন আঙ্গুল। দরীদ্র পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম পিতার তাই ক্ষোভ। জন্মের ১০ দিন পর্যন্ত রাগে ক্ষোভে সন্তানের মুখ দেখেননি তিনি। বাধ্য হয়ে সন্তানের জন্য মা সেলাই মেশিনে বাড়িতে কাজ শুরু করেন। আদরের ছোট ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে সন্তানকে লালন পালন করতে লাগলেন মা। নাম দিলেন জিহাদ। কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হাঁর(আমার) ছেলে সবার সাথে জিহাদ করে আইজ (আজ) ভাল ফল কর্যাছে। হাঁমি খুব খুশি। তবে দীর্ঘস্বাস ছেড়ে বললেন, এখন কে আমার ছেলেকে পড়ার শেষ দায়িত্বটা নিবে। জিহাদ হাসানের মা পারভিন আখতার আরও জানান, পঙ্গুত্ব অবস্থায় জিহাদ জন্ম গ্রহন করায় সমাজের মানুষ আমাকে অনেকভাবে দায়ী করেছে। এমনকি আমার স্বামী তাইফুর রহমানও ১০দিন পর্যন্ত শিশু জিহাদ হাসানকে দেখতে যায়নি। তাতে আমি ভেঙ্গে পড়িনি। তবে মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছি। অতি কষ্টে জিহাদকে বড় করে ৬ বছর বয়সে বি কে স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি করি। সেখান থেকে সে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করে। তারপর তখন তাকে শাহাবাজপুর ইউসি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করি। সেখান থেকে সে অষ্টম শ্রেণীতেও বৃত্তি লাভ করে। শত কষ্ট হলেও ছেলে ভাল ফলাফল করায় এভাবেই অতিকষ্টে এসএসসি পরীক্ষায় ফরম পুরন করায়। পরীক্ষায় আমার ছেলে গোল্ডেন জিপিও ৫ পাওয়ায় আমি খুব আনন্দিত এবং আমি ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থী। পাশে বসা জিহাদ মাকে সান্তনা দিয়ে বলে, নিশ^চয় একটা ব্যবস্থা হবে তার। জিহাদ জানায়, প্রতিবেশীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকে জয় করে জেদের বসে সে সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে সব কাজ করে। এমনকি জন্মের পর যে বাবা তাকে বোঝা মনে করত, সেই বাবাকে কৃষিকাজে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি সব বাধা পেরিয়ে কষ্ট করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়ে এসএসসি তে গোল্ডেন জিপিএ -৫ পেয়ে গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারনে এর পরের শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে রয়েছে তার হতাশা। হতাশা থাকলেও সে আশাবাদি সহায়তা পেলে একদিন সে বুয়েটে ভর্তি হবে এবং একজন প্রকৌশলী হবে। এদিকে, জন্মের পর ছেলেকে অবহেলা করলেও বর্তমানে মাদ্রাসায় কর্মরত জিহাদের পিতা ছেলের ভাল ফলাফলে এখন গর্বিত। জিহাদ হাসান পিতা জানান, দীর্ঘ ২০বছর যাবত তিনি শাহাবাজপুর ইউনিয়নের আজমতপুর দারুল উলুল দাখিল মাদ্রাসার জুনিয়র সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরী করেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এমনিতেই সংসারে অভাব। তার উপরে ৩য় সন্তানকে নিয়ে একটু ভীত হয়ে পড়েন। তবে গত বছর তিনি এমপিওভুক্ত হবার পর এখন যে বেতন পান তাতে তার সংসার স্বাচ্ছন্দে চলে যায়। তিনিও চান তার সন্তানের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিক। তিনি আরও জানান, আমাদের ছোট একটুকরা বসতভিটা ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই। তাই সরকার বা কোন বিত্তবান এগিয়ে আসলে তার ছেলের স্বপ্নটি পূরণ হতো। আর জিহাদের নিজ প্রতিষ্ঠান শাহবাজপুর ইউসি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: উসমান গণির প্রত্যাশা জিহাদের জেদ অনেক। সে যেটা সংকল্প করে সেটা সে করার প্রাণপন চেষ্টা করে। তাই তারাও আশাবাদী ছিলেন যে জিহাদ খুব ভাল রেজাল্ট করবে। তিনি আরও বলেন, জিহাদ যেন সব প্রশ্নের উত্তর সময়ের অভাবে না ছেড়ে আসে তাই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধি হবার কারন দেখিয়ে অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ চাওয়া হলে তা কতৃপর্ক্ষ মন্জুর করায় তিনি কৃতজ্ঞ। এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াত বলেন, দরিদ্রতা ও প্রতিবন্ধীত্ব মেধাশক্তিকে বাধাপ্রাপ্ত করতে পারে না। তা প্রমান করেছে প্রতিবন্ধী জিহাদ হাসান। জিহাদ হাসান আমাদের এলাকার গর্ব, আমাদের অহংকার। তাকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানোর পাশাপাশি সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। সে সাথে তার যদি খেলাধুলা বা অন্য কোন প্রতিভা থাকে, সে বিষয়েও সহযোগীতা করা হবে।