চীন সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে আব্দুর রহমান নামে এক বাংলাদেশী নাবিকের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে ধুম্রজাল। নাবিক আব্দুর রহমান (২৮), চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার শিবপুর-হরিপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশীদের ছেলে। সিঙ্গাপুরের এমটি কনসার্টো নামক জাহাজে গত বছরের পহেলা জুন মধ্যরাতে মৃত্যু হয় নাবিক আব্দুর রহমানের । চট্টগ্র্রাম শিপিং অফিস অসুস্থতার কারনে মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করলেও কোরিয়ান হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কোন কারন উল্লেখ নেই। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে, মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধে। তবে নিয়োগ দানকারী প্রতিষ্ঠান হক অ্যান্ড সন্স কতৃপক্ষের দাবি, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে আব্দুর রহমানের। কিন্তু মরদেহের ভিসেরা রিপোর্টে বিষক্রিয়ার কোন আলামত পাওয়া যায়নি। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুকে রহস্যজনক উল্লেখ করে পুলিশ তদন্তের সুপারিশ করেছে। এ ঘটনার ১৪ মাসেও মামলা নেয়নি পুলিশ। ফলে ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, এমন দাবি নিয়ে বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বীর মুুক্তিযোদ্ধা পিতা হারুন অর রশীদ।
জানা যায়, মেধা, চ্যালেঞ্জ আর সাত সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সাহসের কমতি ছিল না চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশীদের ছোট ছেলে নাবিক আব্দুর রহমানের। সেই দুঃসাহস তাঁর মেরিনার হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বড় দুই ভাইয়ের মতোই ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল যোগদান করেন এই চ্যালেঞ্জিং পেশায়। গত বছরের পহেলা জুন মধ্যরাতে চীন সাগরের এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় তাঁর। কয়েকদিন পর বাড়িতে ফিরে ঈদ করার কথা থাকলেও মৃত্যুর ৪১ দিন পর ফেরেন লাশ হয়ে।
মরদেহের ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট, প্রতিষ্ঠানের নানারকম বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ এবং নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের রিপোর্টে পুলিশি তদন্তের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ঘটনার ১৪ মাস পেরিয়ে গেলেও মামলা নিতে নানারকম টালবাহানা করছে পুলিশ। মৃত আব্দুর রহমানের বড় দুই ভাইও জাহাজের নাবিক। মেজো ভাই হালিমুর রশিদ প্রায় ১৭ বছর ধরে জাহাজের নাবিক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর দাবি, সহকর্মীদের সাথে বিরোধের বিষয়টি কয়েকবার পরিবারকে জানিয়েছিলেন মৃত আব্দুর রহমান। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর দাবি করলেও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শ্বাসরোধে হত্যা উল্লেখ রয়েছে। এমনকি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন থাকলেও পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তাঁর। এমনকি ঘটনাস্থল সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকলেও তার ফুটেজ দেখাচ্ছে না জাহাজ কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন, নাবিক আব্দুর রহমান গত বছরের ১লা জুন চায়নার এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে যাওয়ার পথে রাত ২ টার দিকে ডিউটিরত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় বলে বাংলাদেশি এজেন্ট হক অ্যান্ড সন্স জানায় পরিবারকে। আব্দুর রহমান কিভাবে মারা গেল, জানতে চাইলে কখনো বলেন-বিষাক্ত গ্যাসের কারনে, আবার কখনো মাথায় আঘাত জনিত কারনে মারা যায়। তবে হক অ্যান্ড সন্স চট্টগ্রাম শিপিং অফিসকে মেইল করে জানান আব্দুর রহমান অসুস্থতাজনিত কারনে হাসপাতালে মারা যান। আমরা হক অ্যান্ড সন্সের কাছে বার বার মৃত্যুর কারন লিখিতভাবে ও সিসি টিভি ফুটেজ, ব্রিজ ভয়েস ডাটা রেকর্ড ও আনুষঙ্গিক ডকুমেন্টস চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
হালিমুর রশিদ বলেন, মরদেহ কোরিয়ার হাসপাতালে নিলে বাংলাদেশ এম্ব্যাসি জাহাজের ম্যানেজমেন্ট, কোরিয়ান পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কয়েকবার কথা বললেও তারা মৃত্যুর কারন সনাক্ত নিয়ে কোন সহযোগিতা করেনি। মৃত্যুর ৪১ দিন পর বাংলাদেশে ময়নাতদন্ত হলে মৃত্যুর আগে দেহে জখম ও শ্বাসরোধ করা হয় বলে উল্লেখ করেন চিকিৎসক।
আব্দুর রহমানের পিতা বীর মুুক্তিযোদ্ধা পিতা হারুন অর রশীদ অভিযোগ করে বলেন, জাহাজের সেকেন্ড অফিসার জানত সে কথায় কাজ করছে। আব্দুর রহমান সেকেন্ড অফিসারকে বলে গেছিলো তারপরও আব্দুর রহমান ঠিক আছে-কিনা কোম্পানির ৫ মিমিট পর পর তদরকি করার নিয়ম। জাহাজের ডেকে রাতে একা না পাঠাতে নির্দেশ থাকলেও তা পালন করা হয়নি। কাজে পাঠানোর আগে ডেকের লাইট জ্বালায়নি, আব্দুর রহমানকে রেডিও তে না পেয়ে সময় নষ্ট করছে অন্য জায়গায় কল করেছে, ইন্জিন রুমে কল করেছে, সবায় কে ডাকছে, যদিও সেকেন্ড অফিসার জানত সে কোথায় আছে, তা ব্রিজ থেকে সহজেই দেখা যেত। তারপর যে অবহেলা করেছে তা থেকে বোঝা যায়, হত্যার পর নাটক করছে।
বিষাক্ত গ্যাসে যদি সে মারা যায়, তাহলে তার আগে যারা ডেকে গেল তাদের কিছু হল না? ওর কেন হল নাকি জেনে শুনে মৃত্যুর ফাঁদে ফেলেছিল। আমরা হত্যাকারিদের বিচার চাই। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যদি ছেলে হত্যার বিচার না পাই, তবে আরও নাবিকদের প্রান হারাতে হবে।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে যে সহকর্মীদের দায়ী করা হয়েছে, নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনেও তাঁদেরকে অদক্ষ ও অপেশাদার আচরণের জন্য দোষী করা হয়। তাঁর দাবি, তদন্ত চলমান রয়েছে। তবে এখনও সীদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন তাঁরা বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।