বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ৩ মে। গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমেই ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৬ সাল ছাড়া মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। এই ১৪ বছরের শাসনামলে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪২ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম এবং ১০০ এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪২ দশমিক ২। গত বছর মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম এবং স্কোর ছিল ৩৬ দশমিক ৬৩।
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার হলে অপতথ্য ছড়ায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। জনগণের বৃহৎ স্বার্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জরুরি। কিন্তু সেটির অপব্যবহার যেন না হয়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ইচ্ছা ছিল না, ভবিষ্যতেও নেই। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেটি বিব্রতকর বলে মনে করি। এই সূচকে যে কয়েকটি বিষয় দেখা হয়, তার মধ্যে একটি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর একেবারই কম। সাংবাদিকতা পেশা যে বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীন, সেটিই এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। আর এটা খুব সহজে অনুমেয় যে এর অন্যতম কারণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের মাধ্যমে হুমকির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
২০২৩ সালে প্রকাশিত সূচকে দেখা যায়, ২০২৩ সালে আরও একধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১৬৩তম। এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ৩৫ দশমিক ৩১। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্রস (আরএসএফ) প্রতিবছর ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে থেকে এই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে। আরএসএফের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তারা ২০০২ সাল থেকে এই সূচক প্রকাশ করছে। ২০০২ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৮তম। ২০০৩ সালে তা অবনতি হয়ে দাঁড়ায় ১৪৩তম। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে এই অবস্থান ছিল ১৫১তম এবং ২০০৮ সালে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৬তম। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরিতে আরএসএফ মূলত ৫টি বিষয় বিবেচনায় নেয়। সেগুলো হলো, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও নিরাপত্তা।
২১ বছরের ইতিহাসে গত বছর বাংলাদেশ সবচেয়ে কম স্কোর পেয়ে ১৬২তম অবস্থানে পৌঁছে। এ বছর আরও অবনতি হয়ে পৌঁছেছে ১৬৩তম অবস্থানে। ২০০৯ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল ছাড়া বাংলাদেশ কখনোই গণমাধ্যম সূচকে উন্নতি করতে পারেনি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের তুলনায় ২ ধাপ উন্নতি করে ১৪৪তম অবস্থানে ছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে আবার ২ ধাপ অবনতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৪৬তম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫০তম। পরের বছর এটি ১৫১তম হয়, ২০২১ সালে ১৫২তম এবং ২০২২ সালে ১০ ধাপ পিছিয়ে হয় ১৬২তম।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কখনও তাদের উন্নতি হয়েছে, আবার কখনও অবনতি। একমাত্র বাংলাদেশেরই ২০১৬ সাল ছাড়া এই সূচকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই অবনতি হয়েছে। ১৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নেপাল ২০০৯ সালের ১১৮তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ৯৫তম অবস্থানে পৌঁছেছে। শ্রীলঙ্কা ১৬২ থেকে ১৩৫তম অবস্থানে, পাকিস্তান ১৫৯তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ১৫০তম অবস্থানে আছে। ভুটানের সূচক অবনতি হয়ে ৭০তম অবস্থান থেকে ২০২৩ সালে ৯০তম অবস্থানে পৌঁছেছে। ২০০৯ সালে মালদ্বীপের অবস্থান ছিল ৫১তম। ২০২২ সালে তা ৩৬ ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ৮৭তম। এ বছর দেশটির অবস্থান ১০০তম।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসির (ভি-ডেম) সদ্য সাবেক ভিজিটিং রিসার্চার অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকেই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ছিল শাসন কাঠামো পরিবর্তন করে ফেলবে। এক ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করবে। এই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা থেকে ক্রমাগতভাবে গণমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ২০১১ সালের পর থেকে এই চাপ আরও বেশি করে বাড়তে থাকে। কারণ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী হওয়ার পর তখন সরকার নিশ্চিত হয় যে কোনোভাবেই বিরোধী দলের আর জেতার সুযোগ থাকবে না। দলীয় সরকারের আমলে কখনই দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয় হলে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে সাংবিধানিক পরিবর্তন করা হয়, তারপর বিরোধী দলগুলোর ওপর এবং গণমাধ্যমের ওপর চাপ তৈরি করা হয়। তখন থেকেই দেখতে পাই গণমাধ্যমের ওপর আইন ও আইনের বাইরে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
২০০৯ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আফগানিস্তানের অবস্থান ছিল ১৪৯তম। ২৭ ধাপ উন্নতি করে ২০২১ সাল দেশটি ১২২তম অবস্থানে আসে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান আবার ক্ষমতা দখলের পর ২০২২ সালে আফগানিস্তান ১৫৬তম অবস্থানে পৌঁছে। এ বছর দেশটির অবস্থান ১৫২তম। এই ১৪ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের। ২০০৯ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ১০৫তম। ২০২২ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ১৫০তম। এ বছর দেশটির অবস্থান ১৬১তম।
এদিকে, বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাদের একাংশ এ প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হয়। ২০২২-২৩ সালে পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি করায় ৪৩ জন সাংবাদিককে হামলা-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরিবেশকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কাজের সুযোগ সংকুচিত করা হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমণ্ডির টিআইবি কার্যালয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকটের প্রেক্ষিতে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর ঢাকা অফিস, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও আর্টিকেল নাইনটিন। অন্যদিকে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বিবৃতিতে মহাসচিব বলেন, একটি মুক্ত গণমাধ্যম কোনো বিকল্প নয়, বরং এটি প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস প্রতিবছর আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহিতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। জবাবদিহিতা না থাকলে যেমন কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে, স্বাধীনতাও থাকে না।