স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকার পতনেরও পরও নানা নানা অনিয়ম ও অভিযোগে অভিযুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির সহযোগি হিসেবে কলেজে দাপট দেখাচ্ছে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী। নিজের চেয়ার বাঁচাতে এবং অপরাধ ঢাকতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দিয়ে কলেজের শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হুমকি-ধামকী অব্যাহত রয়েছে। কলেজের সুবিধাভোগী ছাত্রলীগের কর্মী এবং বহিরাগতদের দিয়ে চালানো হচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র ও কৌশল-প্রতিবাদকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দমাতে। অন্যদিকে, যে সকল শিক্ষক অধ্যক্ষের অনিয়মের প্রতিবাদ করতেন, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে নানাভাবে হয়রানী ও মানষিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া, বিধিমালা মোতাবেক কলেজের সিনিয়রদের অধ্যক্ষ হওয়ার যোগ্যতা থাকলেও এজাবুল হক বুলি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সিনিয়রদের পেছনে ফেলে অধ্যক্ষ পদ দখল করে নেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও আওয়ামীলীগের ক্ষমতা খাটিয়ে সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবেও অদ্যবধি রয়েছেন বলেও জানা গেছে। এছাড়াও রয়েছে কলেজের বিভিন্ন কাজের কথা বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগও। তাঁর কথামত না কাজ করায় লাঞ্চিত-বঞ্চিত হতে হয়েছে কলেজের অনেক শিক্ষককে বলেও জানা গেছে। আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পরও অধ্যক্ষ নিজেই আওয়ামীলীগের নেতা হয়ে এখনো ক্ষমতা খাটিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একই কলেজের প্রতিবাদকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপর চালাচ্ছেন অত্যাচার।
“এখনো ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ নেতার দাপট” কিভাবে চলছে? বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজে? এমন নানা প্রশ্ন জেলার শিক্ষানুরাগী ও সচেতন মহলের মনে। ক্ষমতার পতনের পরও কোন অজ্ঞাত কারণে এখনও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কলেজে অনুপস্থিত থেকেও কলেজকে অস্থিশিল করে রাখার সাহস দেখাচ্ছেন কলেজের অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলি? এমন প্রশ্নও এখন জেলার মানুষের মুখে মুখে। ছাত্রলীগ ও অধ্যক্ষের এমন কর্মকান্ড বন্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবীও ভূক্তভোগীদের।
জানা গেছে, ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মীকে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকা অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক বুলি কলেজে প্রবেশের চেষ্টা করে কলেজকে বিশৃংখল অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন বলে কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছেন। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজ এর অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক এর নানা অনিয়ম, দুর্ণীতি, স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা সরকার পতনের পর তার অপসারণ চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি কলেজ লাইব্রেরীতে একটি বই নেই, ক্লাসরুমে চক-ডাস্টার-কলম নেই, কয়েকটি বিষয়ে ক্লাস নেই, হোস্টেলে থাকার জায়গা থাকলেও ব্যবস্থা নেই, কোনো প্রকার কমন রুম নেই, ব্যবহারিক কোনও উপকরণ নেই, কলেজের অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে কলেজের কয়েকটি গাছ কাটা, কলেজে উপস্থিত না থাকা ও লেখাপড়ার মানোয়ন্ননে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ইত্যাদি অনিয়ম ও কলেজ পরিচালনায় অদক্ষতার প্রমাণ তারা কলেজে অধ্যয়নকালে জেনেছেন। কিন্তু তিনি সরকারী দলের ছত্রছায়ায় থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেও কোন কাজ হয়নি বলে শিক্ষার্থীরা জানায়।
এদিকে, আওয়ামী সরকারের পতনের পর এই কলেজের বৈষম্য বিরোর্ধী ছাত্র সমাজ তার পদত্যাগ চেয়ে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। প্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক গত ১৮ আগস্ট দুপুর থেকে গত ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কলেজে অনুপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা আরো দাবি করেছে, এ বিয়য়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবর তারা আবেদন করায় অধ্যক্ষকে গত ২১ আগস্ট কলেজে উপস্থিত থাকতে বলায় তিনি শিক্ষার্থীদের দূর্বৃত্ত ও দুস্কৃতিকারী বলে আখ্যা দিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছেন। আর যে প্যাডে এ উত্তরটি দিয়েছেন, সে প্যাডের শিরোনামে লেখা আছে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ-শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ এবং এতে শেখ হাসিনার ছবিও রয়েছে। এটি তার আওয়ামী প্রীতির বহিপ্রকাশ এবং রাষ্ট্রের পরিপন্থি কাজ বলে দাবি করেছে শিক্ষার্থী সমাজ। এছাড়া তিনি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন বলেও শিক্ষার্থীরা জানান।
এদিকে, অধ্যক্ষ কলেজে উপস্থিত না হয়ে কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মোঃ গোলাম মুর্শেদ এর নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্র ও কয়েকজন শিক্ষককে দিয়ে কলেজে গ্রুপিং-লবিং সৃষ্টি করে কলেজকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করে চলেছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যক্ষ কলেজে বহাল হতে চেয়ে এই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ও মাধ্যমে কিছু শিক্ষার্থীর ভূয়া স্বাক্ষর তৈরী করে গত ৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক এর দপ্তরে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন। এই সব ছাত্রলীগের ছাত্রদের টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়ে গত ২০ আগস্ট থেকে অদ্যবধি কলেজে বিভিন্ন বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টা তিনি করেই যাচ্ছেন বলেও তাদের অভিযোগ।
অন্যদিকে, অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক এর অপসারণ চেয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ গত ২০ আগস্ট থেকে সভা, মিছিল, ডিসি অফিসে আবেদনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছি। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন যে, বীরশ্রেষ্ঠের নামের এ কলেজ পরিচালনায় অধ্যক্ষ এজাবুল হক এর কোন প্রকার যোগ্যতা না থাকায় তার অপসারণ নিশ্চিত করে এবং তার পরিবর্তে একজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার শিক্ষককে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে কলেজকে সুষ্ঠু পরিচালনার আওতায় নেয়ার দাবী জানান।
কলেজের এসব অভিযোগের বিষয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজের অনেক শিক্ষক একমত পোষন করে সকল অনিয়মের সঠিক তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছেন।
এদিকে, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের প্রভাষক সৈয়দা রেহেনা আশরাফি’র অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা ইভটিজিং, র্যাগিং, পেশাগত ক্ষতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে দেয়া অভিযোগের তদন্তে রবিবার (১৫ আগষ্ট) আসছেন একটি তদন্ত দল। গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জীর ও অত্র দপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ আলমাছ উদ্দিন রবিবার তদন্তে আসছেন কলেজের অভিযোগের তদন্তে।
কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দা রেহানা আশরাফীর আবেদনের প্রেক্ষিতে এ তদন্ত হওয়ার কথা চিঠিতে বলা হয়েছে। অভিযোগকারী সৈয়দা রেহানা আশরাফী শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক (বুলি) এর বিরুদ্ধে ইভটিজিং, র্যাগিং, হুমকী, পেশাগত ক্ষতিসাধনসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোট ১২টি অভিযোগ দায়ের করেন। প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে গত ২৩ জানুয়ারী রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসের ২ জন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তদন্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অভিযোগকারী। অবশেষে তিনি আবারও আবেদন করেন তদন্ত করার জন্য। এদিকে, রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসে নতুন পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জী যোগদানের পর অভিযোগটি তদন্তের উদ্যোগ নেন। ১৫ সেপ্টেম্বর রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় পরিচালকের নেতৃত্বে ২ সদস্যের টিম তদন্ত পরিচালনা করার কথা রয়েছে। তদন্তের অপর সদস্য হচ্ছেন একই অফিসের সহকারী পরিচালক (কলেজ) মোঃ আলমাছ উদ্দীন। এই দিন ও তারিখে সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত থেকে তদন্ত কাজে সহযোগিতা করার জন্য রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অনুরোধ জানিয়েছেন।