রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিষয়ে রাজশাহীর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সম্মানিত সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, ব্যুরো চিফ ও সংবাদ প্রতিনিধিদের (গণমাধ্যম কর্মী) সাথে এক মতবিনিময় সভা করেছেন নবনিযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডা. মোহা: জাওয়াদুল হক। মতবিনিময় সভাটি সঞ্চালনা করেন, রামেবি’র রেজিস্ট্রার প্রফেসর ডা. আব্দুস সালাম। এসময় রামেবি’র পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুম মুনির, পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) ডা. জাকির হোসেন খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন।
সভায় লিখিত বক্তব্যে আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে এই বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনাসহ আহতদের দ্রুত নিরাময় কামনা করেন।
ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডা. মোহা: জাওয়াদুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘অকুতোভয় ছাত্র-জনতা বৈষম্যহীন এবং দুর্নীতি ও অনাচারমুক্ত দেশ গড়ার যে স্বপ্ন নিজেরা দেখেছেন এবং জাতিকে দেখিয়েছেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমার আপনার সবার। সেই দায়িত্ববোধে প্রাণিত হয়েই আমরা আজ এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছি। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় সরকার আমাকে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে। গত ১০/০৯/২০২৪ তারিখে আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই কয়েকটা দিন আমাকে চরম ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আমি মনে মনে ভেবেছি সকলের আগে আমার সাংবাদিক ভাইদের সঙ্গে আলাপ করা প্রয়োজন।’
ভাইস চ্যান্সেলর সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা জাতির বিবেক। বা আয়নাও বলা চলে। কারণ আপনারাই দেশের ও সমাজের প্রকৃত চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে আপনাদের ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আমি রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ সম্পর্কে আপনাদের মতামত নেওয়ার জন্য এই মতবিনিময় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, ২০১৬ সালের ১২ই মে প্রকাশিত ২০১৬ সালের ১৮ নং আইন দ্বারা রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত তিনটাÑ এক, রাজশাহী জেলা এবং তার আশেপাশের প্রায় ২ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১২০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা; দুই, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিষয়ক জনবল তৈরি ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০টি ফ্যাকাল্টি চালু করা; এবং তিন, চিকিৎসাসেবার মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা। ইতোমধ্যে আট বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু এখনও এই তিনটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় আমার উপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। আমি যেন এইসব লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত স্বচ্ছতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে পারি সেজন্য রাজশাহী অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে আপনাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রয়োজন।’
ভাইস চ্যান্সেলর বলেন, ‘রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে। প্রথমে রাজশাহী, রংপুর এবং খুলনা বিভাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত ছিল। ২০২১ সালে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন খুলনা বিভাগে অবস্থিত চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক হয়ে যায়। অবশ্য, যেসব শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুরু হয়েছিল সেগুলো শেষ হওয়া পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পরিচালিত হবে বা হচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল, ডেন্টাল, নার্সিং, আইএইচটি, হামদর্দ মিলিয়ে সর্বমোট ৭৬টি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে বর্তমানে কেবল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অফিস, ভবন বা ক্যাম্পাস গড়ে ওঠেনি। সরকারের অনুমোদনক্রমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাম্পাসে তাদেরই ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। তবে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস ও ভবন নির্মাণকল্পে ইতোমধ্যে ৬৭.৬৭৯২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গত ৮ই মে জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণকৃত এই ভূমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। জমি অধিগ্রহণ বাবদ মোট ব্যয় হয়েছে ৭৫৮.৮৩ কোটি টাকা। এদিকে, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ৫৯,১৭১.০০ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে অবমুক্ত হয়েছে ৫৯,১৬৫.০০ লক্ষ টাকা, মোট ব্যয় ৫৮,৬৬৩.০০ লক্ষ টাকা। মোট বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয়ের অগ্রগতি ৯৯.১৫%। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ১৯৫০৪.০০ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে অবমুক্ত হয়েছে ১৭৭১৭.৫৭ লক্ষ টাকা। অবমুক্ত অর্থের বিপরীতে ব্যয় ১৭৭১৬.৩৫ লক্ষ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৯৯.৯৯%। প্রকল্প এলাকায় সীমান প্রাচীর নির্মাণ, এন্ট্রি গেট ও এক্সিট গেট নির্মাণ সংক্রান্ত দরপত্র চুড়ান্ত করা হয়েছে এবং মাটি ভরাট ও বালু ভরাট কাজের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ভাইস চ্যান্সেলর বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একেবারেই অভিভাবকহীন। গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পদগুলো ছিল শূন্য। ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রার এবং পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে স¤পূর্ণ অস্থায়ীভাবে ০৬ মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের নিয়ে আমি কোনও রকমে কাজ শুরু করেছি। ধীরে ধীরে বাকি পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণ গতিতে কাজ শুরু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার আশু লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস ও ভবন নির্মাণ, পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্স চালু এবং গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষে আমি স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চাই। এসব লক্ষ্য ও পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমি রাজশাহী অঞ্চলের সর্বস্তরের জনগণ, এবং বিশেষভাবে সাংবাদিক সমাজের পরামর্শ ও সহযোগিতা কামনা করি।’ সব শেষে তিনি, কষ্ট করে ও মূল্যবান সময় ব্যয় করে তাঁর কথা শোনার জন্য উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর লিখিত বক্তব্য শেষ করেন।
এরপর ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডা. মোহা: জাওয়াদুল হক, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উন্মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের মূলবান পরামর্শ ও মতামত শুনেন এবং তাঁদের সেই পরামর্শ ও মতামতের আলোকে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে দ্রুত বিশ^বিদ্যালয়ের দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।