স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থেকে কয়েকদিন কলেজে হাজিরা দিয়ে গত ১৮ আগষ্ট থেকে প্রায় ৩৬ দিন থেকে কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন জেলা শহরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলি। আওয়ামীলীগ নেতা হওয়ায় এবং ক্ষমতা খাটিয়ে নানা অনিয়ম, দূর্ণীতি, শিক্ষকদের হয়রানী ও নির্যাতন করায় এবং অবৈধভাবে অধ্যক্ষ পদ কুক্ষিগত ও ক্ষমতার অপব্যবহার করায় নানা বাহানা দেখিয়ে কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন এই কলেজের অধ্যক্ষ। ফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনিক নানা জটিলতা। কলেজে অধ্যক্ষ অনুপস্থিত থাকায় কলেজে চলছে হযবরল অবস্থা।
এদিকে, আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন বৈধ পাওনাদাররা ভয়ে পাওনা টাকা আদায় না করতে পারলেও ক্ষমতা পতনের পর থেকেই পাওনাদাররা টাকা নেয়ার জন্য প্রতিনিয়তই ধরনা দিচ্ছেন কলেজে। কিন্তু অধ্যক্ষকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বলছেন নানা কটু কথাও। অপসারণ চেয়ে আন্দোলন সৃষ্টি হওয়া এবং কলেজে অধ্যক্ষ অনুপস্থিত থাকায় কলেজে হযবরল অবস্থা বলছেন কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।জানা গেছে, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক বুলি’র বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এর মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম, অশ্লীলতা, ইভটিজিং, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কলেজের ৬/৭টি গাছ কাটাসহ অসংখ্য অভিযোগ থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তার অপসারণ চাওয়ার আন্দোলন শুরু করে। ফলে গত ১৮ আগস্ট দুপুর থেকে অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক অদ্যবধি কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন। এতে করে কলেজের নিত্য-নৈমিতিক কাজে অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে। কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোঃ জহুরুল ইসলাম জানান, তিনি চিকিৎসাজনিত কারণে বিদেশ যাওয়ার জন্য ছুটির আবেদন করতে চান, কিন্তু অধ্যক্ষ তার ফোন না ধরায় এবং কলেজের কেউ দায়িত্বে না থাকায় বিপদে পড়েছেন বিপাকে।
এদিকে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার একই দিনে কলেজের ৫ জন শিক্ষক কোন নোটিশ ছাড়া রাজশাহীতে প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই কলেজে ৩/৪টি বিষয়ের শিক্ষক নেই, তারপরেও একই দিনে ৫ জন শিক্ষক না থাকায়, শিক্ষার্থীরা ক্লাস না পেয়ে অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিটা আরো জোরদার করেছে। কলেজের একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছে, ৫ জনের মধ্যে জীব বিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক কলেজের সিনিয়র সহকারী অধ্যাপকের কাছে আগে এই প্রশিক্ষণের জন্য ছুটি নিলেও বাকি ৪ জন কার কাছে ছুটি নেন তা জানা যায়নি। তবে অধ্যক্ষ কলেজে অনুপস্থিত থাকায় তার স্বাক্ষরে ছুটি নেয়ার কোন সুযোগ নেই বলে চাকরি বিধিতে উল্লেখ থাকার কথা একটি সূত্র দাবি করেছে। যারা এই প্রশিক্ষণে ছিলেন তারা সবাই রাজশাহীতে বসবাস করেন এবং অধ্যক্ষের কাছে অবৈধভাবে বেশি সুবিধা নিয়ে প্রায়ই এমন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হুমকীর মুখে পড়েছেন বলে জানা গেছে। এই কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক একজন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্নীতি পরায়ণ, অর্থ আত্মসাৎকারী, স্বেচ্ছাচারী হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে অধ্যক্ষ হয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানী করেছেন। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতনের পর তার অপসারণ দাবি করে শিক্ষার্থীরা কলেজে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলন সন্ত্রাসী পন্থায় দমনের উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ গত ১৮ আগস্ট দুপুরের পর কলেজ থেকে গা ঢাঁকা দেন। গত ১৯ আগস্ট তিনি শিক্ষার্থীদের মোবাইল করে তাদের দাবি দাওয়া শুনার প্রস্তাব দিলে শিক্ষার্থীরা রাজি হয়।
কিন্তু অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করে ২০ আগস্ট কলেজে উপস্থিত হননি বরং অধ্যক্ষ এদিন সকালে কিছু বহিরাগত শিক্ষার্থীসহ কলেজের গুটিকয়েক শিক্ষার্থীকে হাত করে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কলেজে অবস্থান করান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়নের হীন উদ্দেশ্যে। সকাল ৯টার পর বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা কলেজে আসা শুরু করলে অধ্যক্ষের অনুসারীরা তাদের উপর মারমুখী হয়ে উঠে। কলেজের সিসি ক্যামেরায় তার প্রমাণ রয়েছে। এক পর্যায়ে সকাল ১০টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর অধ্যক্ষের বাহিনী চড়াও হলে কয়েকজন শিক্ষক তাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। এরপর কলেজের বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা একত্রিত হলে অধ্যক্ষের পক্ষের বহিরাগতসহ শিক্ষার্থীরা কলেজ থেকে সরে যায়।
এসময় অধ্যক্ষকে বিভিন্ন মাধ্যমে কলেজে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের কক্ষে তালা দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এর কার্যালয়ে মিছিল নিয়ে যায়। কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের সাথে যান। শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধির সাথে আলোচনাক্রমে সহযোগিতা চায় এবং কলেজের পরিবেশ অশান্ত করার প্রতিবাদে অধ্যক্ষের শাস্তি দাবি করেন। প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক এর পক্ষ থেকে অধ্যক্ষকে ২১ আগস্ট বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে কলেজে উপস্থিত হতে বলা হয়। এই চিঠির উত্তরে অধ্যক্ষ ৩ জন শিক্ষককে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কলেজের পরিবেশকে আরো অশান্ত করার চক্রান্ত শুরু করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা তখন থেকেই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া অধ্যক্ষ জেলা প্রশাসককে গত ২১ আগস্ট দেয়া পত্রে শিক্ষার্থীদের ‘ভাড়াটে দুস্কৃতিকারি’ ও ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ও অসংখ্য দুর্নীতি ও অনিয়মের হোতা এই অধ্যক্ষের এই বক্তব্য বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থী সমাজের উপরে মিথ্যা অভিযোগ চরম অপমানজনক। তারা এই ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়েছেন।
এদিকে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর রোববার দুপুর ১২টার দিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দা রেহানা আশরাফীর আবেদনের প্রেক্ষিতে এ তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগকারী সৈয়দা রেহানা আশরাফী শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদনে উল্লেখ করা হয়, কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক (বুলি) তাকে ইভটিজিং, র্যাগিং, হুমকী প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষতি সাধন করে আসছেন। প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে গত ২৩ জানুয়ারী রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসের ২ জন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক প্রফেসর ড. বিশ্বজিত ব্যানাজীর নেতৃত্বে তদন্ত টিমের সদস্যরা কলেজে পৌছে প্রথমে অভিযোগকারীর বক্তব্য শোনেন। তদন্তকালে সহকারী অধ্যাপক জোহরুল ইসলাম, প্রভাষক মোহাঃ জোনাব আলী, বিএম মামুনুর রশিদ, মোঃ মজিবুর রহমানসহ আরো কয়েকজন অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেন। তদন্ত টিমের সদস্যরা সার্বিক বিষয় লিপিবদ্ধ করেন এবং খুব তাড়াতাড়ি কলেজের অধ্যক্ষের বিষয়সহ সবকিছুর সমাধান হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। উল্লেখ্য, কলেজের সকল শিক্ষক-কর্মচারী এদিন উপস্থিত থাকলেও একমাত্র অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক কলেজে অনুপস্থিত ছিলেন। আরো উল্লেখ্য যে, তদন্তের সময় কলেজের বৈষম্য বিরোর্ধী ছাত্র সমাজ অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন প্লাকার্ড ও ফেস্টুন প্রদর্শন করে তদন্ত টিমের উদ্দেশ্যে। এসব ফেস্টুনে লেখা ছিল ‘দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ এজাবুলের অপসারণ চাই, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজে ক্যাডার অধ্যক্ষ চাই, চক নাই ডাস্টার নাই-এ অধ্যক্ষের দরকার নাই, শিক্ষক নাই ক্লাস নাই-এ অধ্যক্ষের দরকার নাই, কমনরুম নাই হোস্টেল নাই-এ অধ্যক্ষের অপসারণ চাই, ব্যবহারিক উপকরণ নাই-এ অধ্যক্ষের দরকার নাই, শিক্ষার্থীদের দুর্বৃত্ত বলা অধ্যক্ষের বরখাস্ত চাই, শিক্ষার্থীদের দুস্কৃতিকারী বলা অধ্যক্ষের চাকরী করার অধিকার নাই, ইভটিজিংকারী অধ্যক্ষ বুলির চাকরী থেকে অপসারণ চাই, মাস্তান ও অস্ত্রবাজ অধ্যক্ষ বুলির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দরকার নাই, কলেজের ১০ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাই, অত্যাচারী অধ্যক্ষ এজাবুল হকের চাকরী থেকে ইস্তফা চাই, নারী শিক্ষকদের হয়রানী ও নাজেহালকারী অধ্যক্ষ বুলির স্থায়ী বরখাস্ত চাই, অধ্যক্ষ বুলির নিয়োগ অবৈধ-তাই বাতিল চাই’, ইত্যাদি।
এদিকে, কলেজের আশেপাশের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির কাছে লাখ লাখ টাকা পাবেন এমন কিছু ব্যক্তি প্রতিদিন কলেজের আশেপাশে আসছেন এবং তার খোঁজ করছেন। তারা জানিয়েছেন, আওয়ামী সরকারের আমলে চাকরী দেয়ার নাম করে অনেকের কাছে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ বুলি। এছাড়া ঠিকাদারী করার অজুহাতে বিভিন্ন দোকানে লাখ লাখ টাকার মালপত্র কিনে টাকা পরিষোধ করেন নি। মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালে বিচার ও বিচারের নামে জামানত নেয়া টাকা প্রকৃত লোককে না দিয়ে সরকারী দলের ক্ষমতা দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। কেউ তার কাছে টাকা চাইতে গেলেই তাকে মামলার ভয় দেখাতেন এবং অনেককে মিথ্যা মামলাতেও জড়িয়ে ছিলেন। তারা ভয়ে অধ্যক্ষের কাছে টাকা চাইতে পারতেননা। কিন্তু দেশের পট পরিবর্তন হওয়ায় তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অধ্যক্ষ এজাবুল হক কলেজে আসলেই তার কাছে টাকা আদায় করবেন বলে এসব ব্যক্তি জানান।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, অধ্যক্ষ এজাবুল হক এর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ৫ আগস্টে সরকারের পতনের আগে ও পরে তার বিভিন্ন অপকর্মের বিভিন্ন তথ্য দেশের প্রায় ১০/১২টি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধভাবে কলেজের ৭/৮টি গাছ কাটা, কলেজে ক্লাস রুম সংকট থাকা স্বত্ত্বেও একাডেমিক ভবনকে আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা, লাইব্রেরীতে কোন বই থাকা, প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবের জন্য কোন উপরকরণ না থাকা, চাঁদাবাজি করা, ব্যাপকন বৈষম্যমূলক আচরণ করা, সরকারী অর্থ আত্মসাঃ করার চেষ্টা করা, সময়মত বেতন ফরোয়ার্ড না করা, নিয়মিত কলেজে উপস্থিত না থাকা, ৩/৪ জন মহিলা শিক্ষককে শিক্ষক মিলনায়তনে বসিয়ে রেখে মানসিক নির্যাতন করা, বার্ষিক ও নির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কম্পোজ, খাতা মূল্যায়ন ও হল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের সম্মানী টাকা না দেয়া, টিউশন ফি এর টাকা আত্মসাৎ করা, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে নেয়া, সময়মত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করা, সব কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার করা ইত্যাদি মিলে প্রায় ২ ডজনের বেশি অভিযোগ। আওয়ামীলীগ নেতা হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো, এত অভিযোগ থাকা স্বত্ত্বেও তিনি কলেজে কিভাবে অধ্যক্ষের পদ দখল করে আছেন সেই প্রশ্ন এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নানা মহলে।