চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার হাট-বাজারের খাজনা আদায়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারের নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করে তাদের চাহিদা মতো খাজনা না দিলে মারধরের অভিযোগ উঠেছে খাজনা আদায়কারীদের বিরুদ্ধে। খাজনা আদায় করে দেয়া হচ্ছে না রশিদ। রশিদ দিলেও লেখা থাকছেনা টাকার পরিমাণ। দূরদূরান্ত থেকে আসা কৃষক-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খাজনা। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, ইজারা আদায়কারীদের চাহিদা মত খাজনা না দিলে কৃষক/ব্যবসায়ীদের গলাধাক্কা বা কখনো কখনো মারধরও করা হচ্ছে। ফলে আদায়কারীদের চাপের মুখে বিক্রেতারা অতিরিক্ত খাজনা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া সরকারি খাজনার দরের তালিকা হাটবাজারের দৃশ্যমান জায়গায় টাঙানোর কথা থাকলেও উপজেলার ১৩টি সরকারি হাটের কোথাও তা নেই। ফলে ইজারদার ও খাজনা আদায়কারীরা ইচ্ছে মতো শোষণ করছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের। সরকারি দর না জানায় ক্রেতা-বিক্রেতারাও তেমন কিছু বলতে পারেন না। ভোলাহাট উপজেলার সব থেকে বড় পাইকারি কাঁচাবাজার মেডিকেল মোড়। এখানে উপজেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকেরা সবজি বিক্রয়ের জন্য নিয়ে আসে ও বিভিন্ন এলাকার সবজি ব্যবসায়িরা ক্রয় করে নিয়ে যায়। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত কোনো খাজনার তালিকা নেই। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পণ্য বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি দর সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। খাজনা আদায়কারীরা যে টাকা চান, তা-ই তাঁদের দিতে হয়। বাজার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা ইজাদারদের দায়িত্ব থাকলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা জন্য আলাদা করে টাকা দেয়া লাগে। একই চিত্র ভোলাহাট বাসস্ট্যান্ড বাজার, ফুটানি বাজার, ইমামনগর বাজার, গোহালবাড়ি হাট, বড়গাছি হাটসহ উপজেলার ১৩টি বাজারে। মেডিকেল মোড় কাঁচা বাজারের ভূক্তভুগী এক সবজি বিক্রেতা বলেন, ১৫ কেজি পটলে ২০ টাকা খাজনা দাবি করে। আমি ১৫ টাকা খাজনা দিতে চাইলে আমাকে গালিগালাজ করে এবং তাঁরা আামকে মারার ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে জোর করে ২০ টাকা খাজনা আদায় করে। সবজি চাষি এহসান আলী জানান, এখানে সরকারি নিয়মনীতি ছাড়াই ইজারা তাদের ইচ্ছামত খাজনা আদায় করে। ৪০ কেজি সবজির খাজনা ৬০ টাকা, ক্যারেটে ৩০ টাকা, এক কেজি (মরিচ) ৩ টাকা, যেদিন সবজির দাম বেশি থাকে সেদিন আরো বেশি করে খাজনা আদায় করে। যে প্রতিবাদ করে তাকে অপমান অপদস্থ হতে হয়। আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের আগে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারতো না। এখনো বিক্রেতাদের কাছে ইচ্ছে মত খাজনা আদায় করছে। প্রতিবাদ করতে গেলে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, একজনের কাছে অতিরক্ত খাজনা আদায় করছিল আমি একজন কৃষক হয়ে অন্য কৃষকের কাছে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের প্রতিবাদ করায় গালিগালাজ ও মারধরের ভয় দেখাচ্ছিল। আমি সে সময়ের ভিডিও ধারন করতে গেলে আমার উপরে তাঁরা হামলা করে আমার মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আমার গায়ের শার্ট ছিঁড়ে দেয় তারা। কোন রকমে তাদের হাত থেকে ছুটে আসি। সবজি চাষি তুখলেফুল বলেন, মেডিকেল মোড় কাঁচা বাজারে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করে। সবজির দাম বেশি হলে সবজির খাজনা আরো বেশি করে আদায় করে। অতিরিক্ত টোল আদায় করায় রশিদ চাইলে রশিদ দিলেও কত টাকা দিলাম তা রশিদে লিখে দেয়না। তাঁরা যা বলে সেটাই বাধ্য হয়ে দিতে হয়।
ভোলাহাট উপজেলার গোহালবাড়ি হাটে গিয়ে দেখা যায়, অদৃশ্যমান স্থানে খাজনা আদায়ের মূল্য তালিকা দেখা গেছে। ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, তালিকা কোথায় টানানো আছে আমরা জনিনা। এদিকে সরকারি খাজনা আদায়ের তালিকায় প্রতিটি গরুর ৫’শ টাকা, ছাগল ২’শ ৫০ টাকা, প্রতিটি হাঁস, মুরগী সর্বোচ্চ ১০ টাকা। কাপড়ের চালাঘর ২০ টাকা, কামার, কুমার, মিস্ত্রি, ফেরিওয়ালা দোকান প্রতি ৫ টাকা, বিভিন্ন প্রকার সবজির দোকান ও ডালি ৩ থেকে ১২টাকা, মশলার দোকান প্রতি ১০ টাকাসহ বিভিন্ন দ্রব্য ও মালামালের খাজনা আদায়ের রেট দেয়া থাকলেও অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। অপ্রাপ্ত বয়সের সুমন আলীকে হাঁস, বতক, কবুতরের খাজনা আদায়ের জন্য রেখেছেন ইজারদার। সে জানান, প্রতিটি কবুতর ১০ টাকা, হাঁস ৩০ টাকা, বতক ১৫-২০ টাকা করে খাজনা নিচ্ছি। কাপড়-সেন্ডেলের দোকান, প্রতিটি সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে রশিদ ছাড়া ৩৫ টাকা করে খাজনা নিচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ি ও বিক্রেতারা। গুড় বিক্রেতা লোকমান আলী বলেন, আমাদের কাছে ৩০ টাকা করে খাজনা চাচ্ছিল, আমারা যখন বলেছি ৩০ টাকা করে নিলে আদায়ের রশিদ দিতে হবে তখন ২০ টাকা করে নিচ্ছে।
পিঁয়াজ রসুনের ব্যবসায়ী হুসাইন বলেন, আমাদের কাছে ৪০ টাকা করে খাজনা আদায় করে। আমি ৪০ টাকা করে না দেয়াতে আমার সাথে মাঝে মাঝে ঝামেলা করে। আমি এখন ৩০ টাকা করে খাজনা দিচ্ছি। কর্মকারের খাজনা সরকারি মূল্য ৫ টাকা হলেও ৩৫ টাকা দিচ্ছে বলে জানান কর্মকার সুনীল।
গোহালবাড়ি হাটের একাধিক গরু ব্যবসায়ীরা জানান, যারা গরু ক্রয় করে তাদের কাছে গরু প্রতি ৭০০-৮০০ টাকা ও ছাগল প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা করে খাজনা নিতো। ৫ আগষ্টের পরে গরু প্রতি ৫’শ টাকা ও ছাগল প্রতি ২৫০ টাকা করে খাজনা নিচ্ছে। বেশ কিছু হাটবাজার বেশী মুনাফার জন্য সাব-ইজারা দিয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বেশকিছু হাটবাজার বেদখল হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন খোঁজ খবর নিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। মেডিকেল মোড় কাচাঁ বাজারে ইজারাদার না থাকায় ইজারা আদায় করছেন সাব-ইজারাদার। অভিযোগের বিষয়ে তাঁর কোন কথা বলতে রাজি হননি। মেডিকেল মোড়ের সাব-ইজারাদার বলেন, একজনের সাথে সমস্যা হয়েছে সমাধান করে নিবো।
এব্যাপারে হাটবাজার ইজারা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহামিদা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এমন হলে ইজারদারদের ডেকে পাঠাবো। ঘটনার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।