নারীদের জরায়ু মুখে ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) বিরুদ্ধে এক ডোজ টিকাই যথেষ্ট। আগামী ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা ব্যতীত দেশের ৭টি বিভাগে শুরু হতে যাচ্ছে এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মোট ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৫৯ কিশোরীকে বিনা মূল্যে এ টিকার আওতায় আনতে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। এ উপলক্ষে বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সম্মেলন কক্ষে ইউনিসেফের সহযোগিতায় এবং যোগাযোগ অধিদপ্তরের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রনালয়ের অধিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা তথ্য অফিসের আয়োজনে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন উপলক্ষে অবহিতকরণ সভা হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সামাদ। ‘একডোজ এইচপিভি টিকা নিন, জরায়ুমুখ ক্যান্সার রুখে দিন’ এই শ্লোগানে সাতটি বিভাগে মাসব্যাপী এই টিকা কার্যক্রম পরিচলিত হবে। সভায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্কুল এবং জনবসতি এলাকায় এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রম সম্পর্কে প্রচারাভিযান এবং টিকা নিবন্ধন কার্যক্রম জোরদার করতে জেলার স্কাউট ও গার্লস গাইড সদস্যদের অবহিত করা হয়। এইচপিভি টিকা বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করেন সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ এস এম মাহমুদুর রশিদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডা. রেসমা খাতুন।
জেলা তথ্য অফিসার রুপ কুমার বর্মন এর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাঃ আবদুর রশিদ। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ‘দৈনিক চাঁপাই দর্পণ’ এর প্রকাশক ও সম্পাদক ও চ্যানেল আই প্রতিনিধি আশরাফুল ইসলাম রঞ্জু, জেলা গার্ল গাইড এর সম্পাদক রোকসানা আহমদসহ অন্যরা। এসময় শিক্ষক প্রতিনিধি, সাংবাদিক, জেলা ও উপজেলা গার্ল গাইড ও গাইডার, স্কাউটস এর প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জেলায় বিভিন্ন স্কুলে এবং বিভিন্ন জনবসতি এলাকায় এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রম সম্পর্কে প্রচারাভিযান এবং টিকা রেজিস্ট্রেশন জোরদার করার জন্য জেলার স্কাউট ও গার্লস গাইড সদস্যদের অরিয়েন্টেশন দেয়া হয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রধান অতিথি বলেন, তোমরাও এই টিকাদান কার্যক্রমের প্রচার-প্রচারণার অংশ। এই টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভয়ভীতি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেউ যদি কোনো ভীতিমূলক কথাবার্তা বলে তাহলে তোমরা তা অগ্রাহ্য করবে। তোমরা অনেক মেধাবী এবং প্রগতিশীল। সরকারের এই সুদূরপ্রসারী ও মহৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করার যেকোনো অপতৎপরতা তোমরা রুখে দেবে।
গার্লস গাইডদের পাশাপাশি শিক্ষকদের এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইনকে আরও অংশগ্রহণমূলক করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানান তিনি। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এই টিকা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক বলেন, তুমি তোমার মায়ের কথা চিন্তা করো। এখন যদি তোমার মা না থাকে বা অসুস্থ হয়ে যান তাহলে পরিবারজুড়ে একটি শুন্যতা নেমে আসবে। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে হাজারও মা মৃত্যুবরণ করেন। একটু সচেতন হয়ে সময়মতো এই টিকা গ্রহণ করলে আমরা এটি প্রতিরোধ করতে পারি। সরকারের এই উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসক সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।
সভায় সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ এস এম মাহমুদুর রশিদ জানান, ১৮ দিনব্যাপী এ কর্মসূচির প্রথম দুই সপ্তাহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণি এবং বাকি দিনগুলোতে গ্রুপভিত্তিকভাবে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের বিনা মূল্যে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রায় ৫ হাজার নারী। দেশে নারীদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যানসার এটি। এইচপিভি জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ বছর। আক্রান্ত রোগীদের প্রায় সবাই শনাক্ত হন একদম শেষ সময়ে গিয়ে। তখন আর সেরে ওঠার উপায় থাকে না। কিন্তু, কিশোরী বয়সে মাত্র একটি টিকা নিয়ে সারা জীবনের জন্য এই ক্যানসার থেকে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব। সভায় জানানো হয়, সাধারণত নারীরা যে সকল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন বৈশ্বিক ভাবে তন্মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার চর্তুথ সর্বোচ্চ। প্রতিবছর বিশ্বের ছয় লক্ষাধিক নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে প্রায় তিন লক্ষ ৪২ হাজার জন মৃত্যুবরণ করে থাকেন। এর প্রায় ৯০% মৃত্যুই বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে ঘটে থাকে। বাংলাদেশী নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন জরায়ুমুখ ক্যান্সারে। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে এইচপিভি টিকা সংযোজন করেছে। ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে জেলায় বিভিন্ন স্কুলে এবং এলাকায় ইপিআই কর্তৃক ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের বিনামূল্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধী এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। ঢাকা বিভাগ ব্যতীত সাতটি বিভাগের বিভিন্ন জেলায় এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি চলবে।
আগামী বছর থেকে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হলেই তাকে টিকা দেয়া হবে। টিকা কার্যদিবসে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টিকা কার্যক্রম চলবে। অবহিতকরণ সভায় সহকারী জেলা তথ্য অফিসার মোঃ আব্দুল আহাদ, জেলা গার্ল গাইড এর কমিশনার গৌরি চন্দ সিতু, সদর উপজেলা গার্ল গাইডার হাসনেআরা, শিবগঞ্জের আসমান তারা, নাচোলের রোকেয়া খাতুন, গোমস্তাপুরের আসমা হক ও ভোলাহাটের নুরুন্নাহার সহ মোট ২৬ জন গার্ল গাইড ও গাইডার অংশ নেয়। এছাড়াও ১২জন স্কাউট সদস্য ও জেলা তথ্য অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী সভায় উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, জেলায় এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচীতে জেলা লক্ষ্যমাত্রা ৮৯ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয় ২১ হাজার ৪৯০ জন কিশোরী শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে ৫ম শ্রেনী থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত এবং শিক্ষা বহির্ভূত ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরী ও প্রতিবন্ধীর সংখ্যা সদর উপজেলা-১৯৪০২, শিবগঞ্জে-৩১৮৭৯, গোমস্তাপুরে-১৩৮৩১, নাচোলে-৮৬৫১, ভোলাহটে-৫৮৪৯ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায় ১০০৭৯ জন। জেলায় ৭৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৮৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৯২টি কেজি স্কুল, ৯০টি প্রাথমিক মাদ্রাসা এবং ১৫২টি মাধ্যমিক মাদ্রাসায় এই এইচপিভি টিকা দেয়া হবে। আগামীতে কিশোরদেরও এই টিকার আওতায় আনা হতে পারে বলেও জানানো হয় অবহিতকরণ সভায়।