গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। তা না হলে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলে মনে করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে ‘আ নিউ এরা ইন বাংলাদেশ? দ্য ফার্স্ট হানড্রেড ডেজ অব রিফর্ম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নানা সংস্কার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ করেছে আইসিজি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্কার কর্মসূচির দিকে নজর দিতে চাইলে ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। আওয়ামীলীগ বড় পরিসরে মাঠে না থাকায় বিএনপি এখন সবচেয়ে বড় হুমকি। তবে দলটি অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে। তারা বলেছে, তারা সংস্কারের জন্য ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীদের সময় দিতে চায়। বিএনপিকে ঠেকাতে পারে অন্তর্র্বতী সরকারের দুই প্রধান সমর্থক শিক্ষার্থী ও সেনাবাহিনী। জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভের পর বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের উত্থান হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ইসলাম পন্থিদের, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের প্রভাব বেড়েছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইসলামপন্থি পক্ষগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আন্দোলনে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করেছে। ইতিমধ্যে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে ড. ইউনূসকে আপসও করতে দেখা গেছে। আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনার ক্ষমতাকাল থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে ইসলামপন্থি দলগুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করাটা হিতে বিপরীত হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে এ সরকারকে। এ জন্য ধীরগতিতে হলেও সরকার যে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছে, তা দেখাতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে একটি হতে পারে, রাষ্ট্রীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা দুর্নীতি মোকাবিলা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, পুলিশকে ঢাকার সড়কে ফেরানো। বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনার আমলে হওয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার, তা কেবল জনপ্রিয় হবে না, প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচারকদের জন্য সত্যিকারের দায়িত্ব পালনের পথ তৈরি হবে। এ ছাড়া সংস্কার কমিশনের সদস্যদের বিষয়টি পর্যালোচনা করা উচিত, যাতে সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়। অন্তর্র্বতী সরকার ও সংস্কার কমিশনগুলোর উচিত হবে, শিক্ষার্থী ও সেনাবাহিনীর মতো মিত্রপক্ষ ছাড়াও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসা। সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে সব পক্ষের একমত হওয়াটা সহজ হবে না। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। পাশাপাশি কবে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে, দ্রুত এ-সংক্রান্ত একটি পথরেখা ঘোষণা করা উচিত অন্তর্র্বতী সরকারের। অনেকে দাবি করছেন, বর্তমানে অন্তর্র্বতী সরকার যে রাজনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে, তাতে দেড় বছরের সময়সীমা বেশি বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সেটা সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময়ে হওয়া মামলা ও শেখ হাসিনার শাসনামলে পুরোনো মামলা উভয় ক্ষেত্রে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করা ভালো হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব মামলার বিচার করতে হলে ১৯৭৩ সালের যে আইনে এই ট্রাইব্যুনালের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, সেই আইনে সংস্কার আনতে হবে। এই ট্রাইব্যুনালে অন্তত একজন আন্তর্জাতিক বিচারক রাখতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জাতিসংঘের সমর্থন অব্যাহত রাখা উচিত। সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে কথিত ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলছে, তার লাগাম টেনে ধরা। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূস নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশনের মধ্যে পাঁচটিরই কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ক। ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্র্বতী সরকারকে তার বিস্তৃত রাজনৈতিক সংস্কারের নীতি সফলভাবে এগিয়ে নিতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এমন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তাদের নির্দলীয় ব্যক্তি হতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের সংস্কারকাজে অব্যাহত সমর্থন রাখার আশ্বাস দেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই রাজনৈতিক সমর্থন বেশ গুরুত্ববহ। ড. ইউনূসের উচিত, সরকার ও এর সংস্কার পরিকল্পনায় আরও সমর্থন আদায়ে তার ব্যক্তিগত পরিচিতি কাজে লাগানো। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা। অন্তর্র্বতী সরকারকে দুর্বল করতে পারে, এমন পদক্ষেপ এড়াতে নয়াদিল্লির এখন সাবধানে পা বাড়ানো উচিত। ভারতের উচিত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা, যাদের সঙ্গে দেশটির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
এখন পর্যন্ত বিদেশি শক্তিগুলোর মৌখিক সমর্থন আশাব্যঞ্জক। যেমন কয়েক’শ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা বাড়ানো উচিত। কারণ, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ সরকারের জন্য বড় হুমকি। দাতারা প্রতিশ্রুত কয়েক শ কোটি ডলারের অতিরিক্ত সহায়তা দিলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের উচিত অন্তর্র্বতী সরকার ও আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে কাজ করা। বাংলাদেশ থেকে গত ১৫ বছরে সম্ভবত হাজার হাজার কোটি ডলার অবৈধভাবে সরানো হয়েছে। বেশির ভাগ সম্পদ গেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যে। এসব দেশের বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ জব্দে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।