অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো অন্যায়, অবিচার মোকাবিলা করা যায়। শুধু তাই নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করা যায়। যেটা আমরা জুলাই-আগস্ট মাসে দেখিয়েছি। শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ৮০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবে। নোবেল জয়ী ড. ইউনূস বলেন, কোনো অন্যায়, দোষ না করেও এ দেশের মানুষ কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। অনেক বড় শক্তির মুখোমুখি হওয়াতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যখন আমরা এক হয়ে কাজ করি, তখন আমাদের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করার ক্ষমতা আছে, যেমনটি আমরা ১০০ দিন আগে বাংলাদেশে করেছি। ড. ইউনূস বলেন, মাত্র এক’শ দিন আগে একটি অনন্য রাজনৈতিক উত্থানের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ। গত ১৬ বছর ধরে চলা একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়েছে ছাত্ররা। আমি এই সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অতিথিদের একটি সদ্য উদীয়মান দেশে স্বাগত জানাই।
জুলাই বিপ্লবে প্রায় ১,৫০০ ছাত্র জনতা নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ২০ হাজার আহত হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা তাদের সকলকে শ্রদ্ধা জানাই যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা সারা জীবনের জন্য তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চোখ এবং অনেক শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছে, তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই। ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশনের উদ্বোধন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এই সময়ে এ ধরনের এই সমাবেশের আয়োজন করার জন্য সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজকে ধন্যবাদ জানাই। এই সম্মেলন মনের মিলনের চেয়েও বেশি। এর মাধ্যমে অনেক কিছু নিজেদের মধ্যে ভাগ করা যাবে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিদেশিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ঠিক এক’শ দিন আগে এই শহরে যা ঘটে গেছে, তা আপনার নিজ চোখে দেখে যান। জুলাই বিপ্লবের সময় তরুণদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে রঙিন চিত্রে আঁকা রাস্তার দেয়ালগুলো দেখুন। দেখতে পারবেন কীভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মে কী চায়, তাদের অভিব্যক্তি দেখে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবেন না। এই ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্য অনুরোধ করছি। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে ৭৭টি সেশনে গবেষক, শিক্ষক, লেখক, সমরবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার আট শতাধিক ব্যক্তি অংশ নেন।
পরিবেশগত দিক থেকে বর্তমান সভ্যতাকে অত্মবিধ্বংসী হিসেবে উল্লেখ করে নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) আয়োজনে এই সম্মেলন চলবে সোমবার পর্যন্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসুন আমরা একটি নতুন সভ্যতা তৈরি করি। বর্তমান সভ্যতা আমাদের ব্যর্থ করেছে। পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটা আত্মবিধ্বংসী সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে এটি চূড়ান্তভাবে সম্পদের অসম বণ্টন ঘটিয়েছে। বক্তব্যে তার বহুল প্রচারিত ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্যের তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের তিন শূন্যের বিশ্ব তৈরি করতে হবে, শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদের ঘনত্ব-সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের পরিবর্তে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসা চালু করে, শূন্য বেকারত্ব তরুণদের উদ্যোক্তায় পরিণত করে, চাকরিপ্রার্থীদের পরিবর্তে যা আমরা এখন করি। মানুষের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, যদি আমরা যথেষ্ট পরিশ্রম করে তা অনুসরণ করি।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ঝুঁকির বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখভাগে রয়েছে। প্রতি বছর আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং পরিবর্তিত আবহাওয়ার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট পরে সমাধানের জন্য নয়, এটি অবিলম্বে সম্মিলিত পদক্ষেপ দাবি করে প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বিপুল সম্ভাবনার একটি অঞ্চল। আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ২৭ বছরের কম। কত বড় শক্তি। এটি দেশকে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। আমাদের যুবসমাজের টেকসই উন্নয়নে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার, আমাদের পরিবেশ রক্ষা ও প্রচারের জন্য সবুজ বৃদ্ধির মডেল তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এর জন্য সহযোগিতা, সাহস এবং আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যতের প্রতি অটল বিশ্বাসের প্রয়োজন।