বেক্সিমকো শিল্প পার্কে ১৬টি কোম্পানির ‘অস্তিত্ব না থাকলেও’ সেগুলোর নামে বেক্সিমকো গ্রুপের ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বেক্সিমকো শিল্প পার্কে মোট ৩২টি কারখানার মধ্যে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ১২টি কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লে-অফ করেছে, যা সরকারের সিদ্ধান্ত নয়। সেখানে তিনটি কারখানা বর্তমানে চালু থাকার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, পার্কে অবস্থিত ৩২টি কারখানার বিপরীতে ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকাসহ বেক্সিমকো লিমিটেডের মোট ব্যাংক ঋণ বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের পাওনা ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। উপদেষ্টার এ সংবাদ সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টা আগে এদিন বেক্সিমকো শিল্প পার্কের বন্ধ থাকা ১৬ কোম্পানির মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১১টি কারখানা ‘মানবিক কারণে’ সচল করতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান শ্রমিক-কর্মচারীরা। তারা রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে কারখানাগুলো চালু রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এর আগে তারা দুই দিন গাজীপুরে সমাবেশে ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। ২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর অক্টোবর ও নভেম্বরে বকেয়া বেতনের দাবিতে কয়েক দফা বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেন বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারীরা। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ২৪ নভেম্বর বেক্সিমকো শিল্প পার্কের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি করে, যেটির প্রধান উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন। বৃহ্স্পতিবার সচিবালয়ে এ কমিটির বৈঠক ছিল। শ্রম উপদেষ্টাকে আহ্ববায়ক করে গঠিত এ কমিটির নাম ‘বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’। এ কমিটির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা সাখাওয়াত বলেন, এরইমধ্যে এ কমিটির পাঁচটি সভা হয়েছে। ২৮ নভেম্বর প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো পার্কের শ্রমিক-কর্মচারীদের তিন মাসের বকেয়া বেতনের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বকেয়া বেতন হিসেবে ৫৫ কোটি টাকা; নভেম্বরের বকেয়া বেতন ৫৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা; ডিসেম্বরের বকেয়া বেতন ৪৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দেওয়ার তথ্য দেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের জানুয়ারির বেতন উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের আলোকে দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। এছাড়া আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় অর্থ বিভাগ ৫০ কোটি টাকা এবং সরকারের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১০ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার তথ্য দেন তিনি। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের বিষয়ে বলতে গিয়ে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, “বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে মোট ৩২টি ফ্যাক্টরির মধ্যে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এই ১৬ কোম্পানির বিপরীতে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ১২টি ফ্যাক্টরি ম্যানেজমেন্ট থেকে লে-অফ করা হয়েছে, যা সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের উদ্যোগে মোট ২২৩ কোটি ৪৩ লাখ কোটি টাকা গ্রুপটির কোম্পানিগুলোকে দেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “অত্যধিক ঋণগ্রস্ত অবস্থায় ফ্যাক্টরিগুলো চালানোর জন্য কোনো ব্যাংকই তাদেরকে নতুন ঋণ দিতে পারছে না। সংবাদ সম্মেলনে হাই কোর্টে চলমান রিট মামলায় এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবি পরিবর্তন, অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবি নিয়োগ এবং বেক্সিমকোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, রোববার (২৬ জানুয়ারি) বেক্সিমকো শিল্প পার্কের কোম্পানিগুলোর আর্থিক সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সভা ডাকা হয়েছে। এর দুদিন পর দায়-দেনা নিয়ে পর্যালোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেদিন উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং দায়-দেনা ও সম্পদের বিবরণ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে অস্থিরতা চলছে। শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে বন্ধ রাখা হয়েছে বেক্সিমকো শিল্প পার্কের অধিকাংশ কারখানা। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে গ্রুপটির বেশির ভাগ উদ্যোক্তা আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকগুলো ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ থাকায় এলসি খুলতে পারছে না কোম্পানি। ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া বন্ধ হওয়ায় নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো।