বরেন্দ্র জনপদসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে, বাড়ি আঙ্গিনায় থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে, রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো তাল গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়তো। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের এ তালগাছ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। তালগাছের সর্বাঙ্গ থেকে নানারকমের জিনিস তৈরী করা হয়। তালগাছের কিছুই ফেলার মতো নেই। সব কিছু কাজে লাগে। যেমন তালগাছের তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকবার পট, লেখবার পুঁথি, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরী করা যায়। এমনকি তালের কাট দিয়ে বাড়ি, নৌকা, হাউস বোট ইত্যাদি তৈরি করতো ওই সময়ের শিল্পীরা। এছাড়াও পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে তাল রস দিয়ে তাল পিঠাসহ নানারকমের পিঠা বানানো হতো। তালের রস এবং তালের ফল ছিল বাঙালির জন্য সুস্বাদু খাদ্য। পাকা তালের পিঠা আর কাঁচা তালের শাঁস খেতে দারুণ সুস্বাদু ছিল। তাছাড়া তাল পিঠা দিয়ে আত্মীয়ের,মেয়ের শ্বশুর বাড়িসহ নানাজনের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরিতে সহায়তা হতো। এখন সেই আত্মীয়তা আর নেই। যেভাবে দিন দিন তালগাছ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মরা সেই তালের স্বাদ পাবে কিভাবে ? নতুন প্রজন্মের কাছে সেটি অজানাই রয়ে যাবে। এদিকে, আবু আব্দুল্লাহ ও মুশফিকুর রহমান নামে দুই কৃষক জানান, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কাঁচা তাল ফলের শাঁস খাওয়ার জন্য চারদিকে হাক-ডাক পড়ে যেতো। চলতো শাঁস খাওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা। আবার শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তালগাছের তলায় গেলেই পাকা তালের সুবাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যেত। এমনকি ভাগ্যে থাকলে দু’চারটি পাকা তালও পাওয়া যেতো। দূর থেকে শোনা যেত তালগাছ থেকে তাল পড়ার শব্দ। আরো শোনা যেত তালপাতার ডালে বুলানো বাসা বাবুই পাখির কিচির-মিচির শব্দও। তখনকার সময়ে তালের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো বরেন্দ্র জনপদের প্রতিটি বাড়ি। ঘরের বউ ঝিয়েরা পাকা তালের আটি থেকে হলুদ রস বের করে নানান রকমের পিঠা বানাত। যা ছিল অতিসুস্বাদু। বর্তমান প্রজন্মের স্বাদ আর মর্ম না বুঝলেও আগের প্রজন্মের অনেকেই হারিয়ে যান পুরনো স্মৃতিতে। তবে এখন আর আগের মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে না। সেই কারিগর বাবুই পাখির বাসা ছিল বড়ই নয়াভিরাম। বাবুই পাখির কিচির-মিচির শব্দ শোনা গেলেও এখন আর সেই কিচির-মিচির শব্দ শোনা যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গবেষক ও পরিবেশবিদ জানান, আমাদের দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এজন্য তৎকালীন সরকার দেশের জাতীয় দূর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতের মৃত্যুকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং একে নতুন দূর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। আমাদের দেশে যে হারে তাল গাছ কাটা হচ্ছে, সেই হারে কিন্তু তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না। বজ্রপাতের মৃত্যু থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে তালগাছ। তিনি আরো জানান, তালগাছ বজ্রপাত গাছ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি দীর্ঘজীবি উদ্ভিদ। যা সাধারণত ৮০-১০০ ফুট উঁচু হয় এবং কমবেশি শতবর্ষ পর্যন্ত বাঁচে। এটি উচু বৃক্ষ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এই গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। বজ্রপাত প্রতিরোধের পাশাপাশি তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, ভূমিক্ষয় রোধ, ভূমিধস, ভুগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি, মাটির উর্বতা বৃদ্ধি ও পরিবেশের উষ্ণতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বজ্রপাত ও ঘূর্ণিঝড়সহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তালগাছ রোপন কর্মসূচি হাতে নেয়া জরুরি বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।