বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজ এর বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মোহাঃ জোনাব আলী জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২৩ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। সদর উপজেলায় কলেজ পর্যায়ে তিনি এ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আমিরুল ইসলাম এর কাছ থেকে তিনি সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহণ করেছেন।
বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান ও নিষ্ঠা, প্রশ্নপত্র তৈরীর অভিজ্ঞতা, শ্রেণী পাঠদানের সক্ষমতা, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, সহকর্মী ও কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার প্রবণতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব, সততা ও সুনাম. শৃঙ্খলাবোধ, দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা, শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে নিয়মানুবর্তিতা, ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরী এবং শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন, পেশাগত/গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনা, সেবা ও স্বেচ্ছামূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা ও কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা হয় শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক বাছাই প্রতিযোগিতায়।
শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে ক্রেস্ট ও সনদ উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। জোনাব আলী গত কয়েক বছর থেকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নিয়ে থাকেন। তার ক্লাস গ্রহণ সম্পর্কে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, প্রভাষক জোনাব আলী ক্লাসে পৌঁছেই সালাম দেন এবং সকলের খোঁজ-খবর নেন। তিনি যতক্ষণ ক্লাসে থাকেন, ততক্ষণই ছাত্রছাত্রীরা স্বাচ্ছন্দবোধ করে এবং মনোযোগ সহকারে ক্লাস করেন। প্রজেক্টরে ক্লাস শুরু করে তিনি বিভিন্ন কৌশলে ছাত্রদের পাঠের দিকে মনোযোগী করে তোলেন। শ্রেণীকক্ষে তিনি সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকেন। তার প্রতিটি ক্লাস খুব আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা উপভোগ করে থাকে। ছাত্ররা বাংলা স্যারকে আদর্শ শিক্ষক বলে মনে করে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক জোনাব আলীর অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, আমি সব সময় ভাল কিছু করার চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি ভাল কাজের ফল একদিন পাওয়া যাবেই। এটি মহান আল্লাহ’র ইচ্ছা। এ সম্মাননা পেয়ে আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মচারীসহ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আমার জন্য দোয়া করেছিলেন বলে পুরস্কারটি পাওয়া আমার কাছে সহজ হয়েছে।
তিনি, ৯০ এর দশকে লেখক হিসেবে জেলা গণগ্রস্থাগার, ১৯৯৮ খ্রীস্টাব্দে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া উন্নয়ন ট্রাস্ট থেকে সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করি এবং ২০১৪ খ্রীস্টাব্দে মহারাজপুর চেতনা সামাজিক সংগঠন চেসাস কর্তৃক প্রথমবারের মত প্রদত্ত মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫ গুণী ব্যক্তির মধ্যে একজন হিসেবে সংবর্ধনা প্রাপ্ত হন। গত ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু বই মেলায় জেলার লেখক হিসেবে তিনি সম্মাননা স্মারক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকেও বেশ কিছু সম্মাননা সনদ লাভ করেছেন। তিনি বহুমূখী সৃজনশীল ও গবেষণামূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। মোহাঃ জোনাব আলী ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের চকটোলা বালুবাগান গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাঃ গুধু মন্ডল ওরফে বাহার আলী (মরহুম)। তিনি ৮ ভাই-বোনের (১ বোন ও ৭ ভাই) মধ্যে ৬ষ্ঠ।
তিনি কারবালা সরকারী প্রাথমিক ও কারবালা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং ১৯৮৪ খ্রীস্টাব্দে চামাগ্রাম হে.না উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি কৃষ্ণগোবিন্দপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৮৭ খ্রীস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দে বি.এ পাস করেন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিভিয়াস এবং ১৯৯৫ খ্রীস্টাব্দে মাস্টার্স পাস করেন।
স্কুল জীবনে তিনি প্রথমে গান লেখা দিয়ে সাংস্কৃতিক জগতে প্রবেশ করেন। পরে ছোটগল্প, নাটক ও কবিতা লেখাও শুরু করেন। তিনি ১৯৮৯ খ্রীস্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক নবাবগঞ্জ বার্তা’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা এবং পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধ, ছোট গল্প লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৯৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত ‘গীতিকার’ এবং ১৯৯৮ খ্রীস্টাব্দে ‘নাট্যকার’ হিসেবে অনুমোদন লাভ করেন। ২০০৫ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘গীতিকার’ হিসেবে তিনি তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ বেতারের রাজশাহী কেন্দ্রে তার লেখা ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার চিঠি, ‘মুক্তিযুদ্ধের অলৌকিক জীবন’ ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার সংসার’ ‘বিয়ে’ ‘বসন্তের স্বপ্ন’ ‘সমাজের নেপথ্যে’, ‘দৃষ্টির আড়ালে’, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস’ সহ আরো কয়েকটি নাটক ও কিছু নাটিকা রাজশাহী কেন্দ্রে প্রচারিত হয়েছে। ১৯৯৬ ও ২০০০ খ্রীস্টাব্দে শরীফ রানা ও সুনীল কুমারের কণ্ঠে তার লেখা গান প্রথম বাজারে আসে।
আধুনিক, পল্লীগীতি ভক্তিমূলক পল্লীগীতি, দেশের গান, ভাষার গান, বিয়ের গান, বিদায়ের গানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রায় দেড় হাজার গান লিখেছেন। প্রায় ২৫০টি গবেষণামূলক মৌলিক প্রবন্ধ, ৫০টি ছোট গল্প, শতাধিক কবিতা লিখেছেন, যেগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি ২০০০ খ্রীস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর থেকে ‘সাপ্তাহিক সোনামসজিদ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছেন। কলেজ সরকারী হওয়ায় তিনি এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।
এর আগে ১৯৮৯ খ্রীস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারী ‘মহারাজপুর সাহিত্য পরিষদ’ গঠন করেন এবং ‘বিকাশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকাটি ১৯৯৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বছরের বিশেষ দিনগুলোয় প্রকাশিত হতো।
তিনি দু’টি প্রবন্ধের বই প্রকাশ করেছেন। প্রথম বই এর নাম ‘দুর্বলের আত্মীয় নেই’। এ বইটি ২০০৭ খ্রীস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বই এর নাম ‘বিচার চাই’। এটি ২০১৫ খ্রীস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল প্রকাশ হয়। দু’টি বই-ই মৌলিক গবেষণামূলক এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের প্রতিফলন।
২০০৩ সালের ১৮ মে থেকে তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজ’-এ বাংলা বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি দেশের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথেও জড়িত রয়েছেন।