চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবছর একদিকে আমের ফলন বিপর্যয়, রয়েছে ওজন জটিলতাও। আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা দাবী জানালেও কোন অজ্ঞাত কারণে ওজন জটিলতার নিরসন হচ্ছে না। বেশি ওজন দিয়ে আম বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় আম চাষী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম ক্ষোভ। অন্যদিকে, প্রচন্ড তাপদাহের পর আশির্বাদী বৃষ্টি হলেও আম চাষীদের মুখের হাঁসি অনেকটায় মলিন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কালুপুর গ্রামের আমচাষী আব্দুর রশিদ। ৩ সন্তান কে নিয়ে বাপ-দাদার পেশা কৃষি দিয়েই চলে ৬০ বছর বয়সী এ কৃষকের সংসার। কৃষি উপকরনের দাম বৃ্িদ্ধ এবং শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় ৩ সন্তানের এ জনক সন্তানদের নিয়ে নিজেই চাষ করেন জমি। ৫ বিঘা আমবাগানের পুরোটা নিজেই পরিচর্যা করেন। আর এ থেকে আয় দিয়ে চলে তাদের সংসার। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে তার বাগানে এবছর ৩’শ মনের জায়গায় আম উৎপাদন হবে মাত্র ৪০ মন। বেড়েছে কৃষি উপকরনেরও দাম। তার উপরে তীব্র খরায় আম রক্ষা করতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয় তাকে। ছেলেকে নিয়ে সাধ্যমত পানির সেচও দেন। তবে গত সপ্তাহের বৃষ্টির পর হারানো হাঁসির ঝলক দেখা গেল তার চোখে মুখে। তবে যদি এবছর আমের সঠিক ওজন ও নায্য মূল্য পান, তবেই খরচ উঠে সামান্য লাভের আশা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “হাঁরা (আমরা) খেটে খাওয়া মানুষ। বাজারে আমের দাম প্যালে(পেলে) গায়ে গতরে (নিজেদের পরিশ্রমে) খাটার (কাজ করার) কষ্ট ভূল্যা যাব। তিনি বাজারে আমের ওজন সহনীয় মাত্রায় রাখার আবেদন জানিয়ে বলেন, হাঁরা কষ্ট কইরা আম ফলিয়ে বাজারে আম লিয়ে(নিয়ে) গেলে ৫০ কেজিতে মণ ধরে জোর করে আম ল্যায়। তাই বিষয়টি সরকার ক্যানে দেখেনা?” এ অবস্থা শুধু রশিদের নয় সকল চাষীদেরই। তবে যারা জমি লীজ নিয়ে বা র্দীঘমেয়াদে বাগান কিনে আম চাষ করছেন তাদের অবস্থা আরও খারাপ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবছর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত এবং অফইয়ারের কারনে ফলন বিপর্যয় হলেও গত সপ্তাহের আর্শিবাদী বৃষ্টিতে চাষীদের মুখে হাঁসি ফুটেছে। তবে ওজন জটিলতা এবং আম পাড়ার সময় সীমা বেধে দেয়ার আশংকায় আতঙ্কিত চাষীরা। আম বাগানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সকল চাষী গাছের গোড়ায় বৃষ্টির পানি জমে থাকায় সেচকাজ বন্ধ করে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত। কেউ কীটনাশক প্রয়োগ, আবার কেউ কেউ আমে ব্যাগ পড়াতে ব্যস্ত। অনেকে আমের ভার রক্ষায় বাঁশের ঠেকা এবং বাগান পাহারা দেয়ার জন্য পাহারাদারের ঘর তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এবার বাগানগুলোতে মাত্র ৩০/৪০ ভাগ আম থাকলেও সঠিক ওজনে নায্য মূল্যে আম বিক্রি করতে পারলে লোকসান ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন আম চাষীরা। পিঠালীতলার চাষী আব্দুল লতিফ কানসাট বাজার সহ বাংলাদেশের সব আম বাজার গুলোতে একই ওজনে আম কেনাবেচার দাবী করেন। তিনি বলেন, আম বাজারে বিক্রির সময় অতিরিক্ত আম যে এলাকায় বেশি পাওয়া যায়, বেপারীরা সেখানেই চলে যায়, এতে করে চাষীরা ৩ মন আম বিক্রি করতে গিয়ে প্রায় ১ মন আম ফ্রি দিতে বাধ্য হচ্ছে। আম কাঁচামাল হওয়ায় বিক্রি করতে না পারার ভয়ে চাষী বাধ্য হন বেশি আম দিতে। শিবগঞ্জের আম চাষী আহসান হাবিব জানান, আন্দোলন করেও এর সমাধান হচ্ছেনা। উল্টো আড়ৎগুলো এক মনের জায়গায় ৪৫ থেকে ৫০ কেজি আম নিলেও দাম দেয় এক মন আমের।
তবে কানসাট আম আড়ৎদার সমিতির সাধারন সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু জানান, আমরাও চাই চাষীদের কাছ থেকে সঠিক ওজনে আম নিতে। কিন্তু রাজশাহী ও নওগাঁয় এক মনের জায়গায় ৫০/৫৫ কেজিতে আমের মন হওয়ায় বাইরের ক্রেতারা ঐসব এলাকায় চলে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রশাসন ৪০ কেজি তে মন চালু করায় ১৫ দিন ক্রেতা শূণ্য ছিল কানসাট বাজার। আম নিয়ে বিপাকে পড়েন চাষী ও আড়ৎদারগণ। তাই এ উদ্যোগ নিলে সারা দেশেই নিতে হবে, নয়ত ক্ষতিগ্রস্থ হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
জেলা মার্কেটিং অফিসার মনোয়ার হোসেন জানান, গত রবিবারের (১২ মে) মাসিক সম্বন্বয় সভায় জেলা প্রশাসক কঠোরভাবে আমের মন ৪০ কেজিতেই বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে। তবে অন্য জেলাগুলোতে এ নিয়ম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সব জেলায় সম্বন্বয় না হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাইরের ক্রেতা সংকটে থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি। তবে তিনি রাজশাহী জেলার দায়িত্ব থাকাকালে ওজন জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নে ব্যার্থ হন বলে স্বীকার করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার জানান, দেশের যে কোন স্থানের তুলনায় এ জেলায় আম পরিপক্ক হবার পর তা বাজারজাত করা হয়। বিশেষ করে গত বছর তীব্র খরায় তাপমাত্র বাড়ার কারনে নাভী এবং মধ্য সময়ে পরিপক্ক ভ্যারাইটির আম একসাথে পেকে যায়। যার কারনে গত বছর সময় সীমা বেধে দেয়া হয়নি। এজন্য এবারও তিনি সময়সীমা বেধে দেয়ার পক্ষে নন। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের উপর। এ নিয়ে ১৬ মে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মত বিনিময় সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সেসাথে সারা দেশের কোন জেলার রপ্তানীযোগ্য নিরাপদ আম, কখন পরিপক্ক হবার পর বাজারজাত করা হলে বা রপ্তানী করা সম্ভব হবে, এমন পরিকল্পনায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভার একটি ধারনাপত্র ঐ সভায় উপস্থাপন করা হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছর জেলায় ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে ৭৫ লক্ষ ৮৯হাজার ৮২৫ টি আমগাছে আম চাষ করা হচ্ছে। এবছর মুকুল কম আসায় এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারনে আমের উৎপাদন কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা না বাড়িয়ে গত বছরের ন্যায় মোট ৪ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।