পৈত্রিক সম্পত্তি ও লিজ নিয়ে জমিতে আম বাগান করেও এলাকাবাসীর অত্যাচারে অতিষ্ট এবং দিসেহারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যোক্তা কৃষক নোমান আলী। প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি। নিজে এবং বাগানের শ্রমিকদের নিয়েও ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন কৃষক নোমান। এলাকার কিছু উঠতি কিশোর এবং স্থানীয়দের যোগসাজসে বাগান থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে এমন অত্যাচার এবং বাগানের ক্ষয়ক্ষতি করছে পাশর্^বর্তী গ্রামের মানুষ বলে অভিযোগ ভূক্তভোগী কৃষক নোমান আলীর। স্বাভাবিকভাবে বাগান পরিচর্যা এবং ফল উৎপাদনে নিরাপত্তার দাবী তাঁর।
কৃষক নোমান আলী ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্যোক্তা কৃষক নোমান আলীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আলীনগর মহল্লায়। শিক্ষিত কৃষক নোমান নিজেকে কৃষি কাজে নিয়োজিত করে পাশর্^বর্তী রাজশাহী জেলার তানোর থানার বাধাইড় ইউনিয়নের ধামধুম এলাকায় পৈত্রিক জমি সাড়ে ১৫ বিঘা এবং পাশর্^বর্তী প্রায় ১৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে আম বাগান তৈরী করেন। অন্য জেলায় হলেও জমিটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। প্রায় ১২ বছর আগে বাগান তৈরী করেন এবং ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন আম্রপালি, ব্যানানা, বারি ৪, ক্ষিরসা, বোম্বায়, ল্যাংড়া গাছের আম বাগান তৈরীতে। বাগান তৈরীর পর ফল আসতে শুরু করে। বাগানের ফলন ও ব্যবসার উন্নতি দেখে এলাকার কিছু মানুষের কু-দৃষ্টি পড়ে নোমানের বাগানের উপর। মাঝে মধ্যেই আম পেড়ে নিয়ে যাওয়া, আম নস্ট করাসহ নানা অত্যাচার শুরু করে পাশর্^বর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আমনুরা কলেজপাড়ার কিশোররা ও কিছু লোকজন। এরই জের ধরে এবছর কোরবানীর ঈদের আগের দিন কেটে ভেঙ্গে নস্ট করে প্রায় দেড় শতাধিক বিভিন্ন আম গাছ এবং ১০মন মতো আমও। এতে প্রায় ৬ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয় কৃষক নোমান আলীর। পরের দিন গাছ কাটার সময় হাতেনাতে এলাকার কয়েকজন কিশোরকে আটক করে বাগানের মালিক নোমান ও শ্রমিকরা। এরই জের ধরে গ্রামের শতাধিক লোকজন লাঠি সোঠা নিয়ে নোমানের বাগানে এসে নোমানকে এবং ব্যবসায়ীক পার্টনার শওকত হাবিবকে বেধড়ক মারধর করে এবং ধরে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। সেখানেও মারধর করা হয় তাদের। গ্রামের লোকজন আটককৃত কিশোরদের জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরে আমনুরা ফাঁড়ির পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে কৃষক নোমান ও শওকত হাবিবকে।
পরের দিনই আবারও এলাকার ৮জন কিশোর লাঠি-সোঠা নিয়ে বেলা ১১টার দিকে বাগানে ঢুকে গাছ কেটে এবং ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করে। এসময় শ্রমিকরা বাধা দিলে প্রানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে কিশোররা প্রায় ৪০টি গাছ নষ্ট করে। প্রাণভয়ে শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে পালিয়ে আসলে ওই গ্রামের কিশোর ও বখাটেরা আম লুটপাট করে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে বাগানের প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ মন আম লুট করে নিয়ে যায় বখাটেরা।
এনিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ পুলিশকে লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক নোমান। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করে স্থানীয় লোকজন এবং তানোর উপজেলার মন্ডুমালা ফাঁড়ির পুলিশ কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে ঝিলিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সমাধানের চেষ্টা করলেও আবারও একই গ্রামের কিশোররা বাগানের ৩৫ থেকে ৪০টি আম্রপালি আম গাছ ভেঙ্গে এবং কেটে ফেলে রেখে চলে যায়। অভিযোগ দেয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে গ্রামের বড়দের ইশারায় এসব কাজগুলো করে এলাকার কিশোররা রাতে বা নির্জন সময়ে। ঝিলিম ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বাদশা আলী বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব নিলেও কিশোরদের উস্কানি দিয়ে গাছ ও আমের ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। সব মিলিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন উদ্যোক্তা কৃষক নোমান। শেষ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষক নোমান ও বাগানের শ্রমিকরা। অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বড়রাও নানাভাবে হুমকী দিচ্ছে। এসব ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত করে বাগানের গাছ ও ফল নস্টের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং বাগান ও নিজের এবং বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী ভূক্তভোগী উদ্যোক্তা কৃষক চাঁপাইনবাবগঞ্জের নোমান আলীর।
বাগান পাশর্^বর্তী মিনি ডিপ ড্রাইভার জালাল উদ্দিন বলেন আমি নোমান ভাইয়ের বাগানের পাশর্^বর্তী মিনি ডিপে ড্রাইভারী করি। বেশ কিছুদিন থেকেই এলাকার কিছু বখাটে নোমান ভাইয়ের বাগানের গাছ ভেঙ্গে এবং কেটে নষ্ট করে দিচ্ছে। এ নিয়ে নোমান ভাই অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ। এরা রাতে এবং দিনের বেলায় নিরিবিলি সময়ে এসব করে। এসব কিশোর বখাটেদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা খুবই জরুরী।
স্থানীয় ইউপি সদস্যের স্ত্রী নুরজাহান বেগম বলেন এলাকার কিশোর ছেলেরা নোমান আলীর বাগানের গাছপালা নষ্ট করেছে প্রায় ২ শতাধিক। তবে, কে বা কারা রাতের অন্ধকারে এসব করেছে। এনিয়ে নোমান ভাই এলাকার একজন কিশোরকে ধরে চড় থাপ্পর মারে। এতে গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে বাগানে এসে হামলা চালায় এবং নোমান ভাইকে প্রচুর মারধর করে। পরে এসব নিয়ে অনেক কিছুই ঘটনা ঘটে। এরই জের ধরে গ্রামের বড়রাও নোমান ভাইয়ের বাগানের ক্ষতি করার জন্য কিশোরদের লেলিয়ে দেয় এবং ক্ষতি করতেই থাকে। তবে, যে বা যারাই এই ক্ষতি করুক, তাদের বিচার করতে হবে এবং নোমান ভাইয়ের বাগানের ক্ষতিপুরন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
নোমান আলীর বাগানের শ্রমিক সুবাস জানান, আমরা বাইরে থেকে এসে এখানে বাগান তৈরী করেছি। নোমান ভাইয়ের বাগানে দীর্ঘদিন থেকেই কাজ করছি। নোমান ভাইয়ের বাগানের আম এবং আম গাছের ক্ষতি করছে দীর্ঘদিন থেকেই পাশর্^বর্তী গ্রামের কিশোর গ্যাং। তবে কিছুদিন থেকে এর মাত্রা বেড়েছে। কোরবানীর ঈদের পর থেকে যখন তখনই গাছ কেটে দিচ্ছে, ভেঙ্গে দিচ্ছে। আম পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, গাছেরগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে, নোমান ভাইয়ের বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের নানাভানে হুমকি ধামকি দিচ্ছে, যেন শ্রমিকরা কাজ না করে বাগান ছেড়ে চলে যায়। একথায় বাগানের উন্নতি দেখে এলাকার মানুষের চরম হিংসার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে ক্ষয়ক্ষতি এবং জালাতন করলে যেন মোনান ভাই বাগান ছেড়ে পালিয়ে যায়। তারা যেন নোমান ভাইয়ের জমির ফসল এবং বাগানের ফল লুটপাট করে খেতে পারে। নোমান ভাইয়ের বাগান ও সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানায়।
স্থানীয় দোকানদার সাদিকুল ইসলাম বলেন, নোমান ভাইয়ের বাগানের অনেকগুলো গাছ কেটে এবং ভেঙ্গে নস্ট করেছে দুর্বৃত্তরা। তবে, যে বা যারাই একাজ করুক, ঠিক কাজ করেনি। মানুষের সাথে শত্রুতা থাকতে পারে, কিন্তু গাছের সাথে কি শত্রুতা। গাছ কেন নস্ট করবে। যেসব বখাটেরা এসব করেছে তাদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি হওয়ার দরকার।
স্থানীয় গ্রাম্য মড়ল মনিরুল ইসলাম বলেন, নোমান ভাই তার পিতার জমিসহ পাশর্^বর্তী জমি নিয়ে এখানে আমের বাগান তৈরী করেছে। এলাকার মানুষের কোনদিন কোন ক্ষতি করেনি। নোমান এলাকার মানুষের উপকার করেছে। তাঁর বাগানে অনেক শ্রমিক কাজ করে। বেশ কিছুদিন থেকেই নোমান ভাইয়ের বাগানের আম গাছ কেটে ভেঙ্গে নস্ট করছে পাশর্^বর্তী গ্রামের কিশোর ও লোকজন। নোমান এর বাগানের আমও নস্ট এবং পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে জোরপূর্বক। শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে ওইসব কিশোররা। আর এতে সহযোগিতা করছে বড়রাও। নোমান ভাইয়ের উন্নতি দেখে প্রতিহিংসা করেই বখাটেরা এসব করছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করে নিরাপদে ব্যবসা এবং নিজস্ব পৈত্রিক সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিৎ। এছাড়াও নোমান ভাই ও তাঁর বাগানের শ্রমিকদের নিরাপত্তাও জরুরী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বলেন, নোমান আলীর অভিযোগে জানতে পারি আমার ঝিলিম ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ড এর এলাকার কিশোর ও লোকজন এসব ক্ষতি করছে। তবে আমার এলাকার হোক বা অন্য এলাকার হোক, একটি গাছের ক্ষতি করা, মানে এটি একটি জাতীয় ক্ষতি। একটি গাছ তৈরী করতে কি শ্রম ও অর্থ খরচ করতে হয়, তা এসব বখাটেরা জানে না। যদি জানতো তাহলে এমন কাজ তারা করতে পারতো না।
বাগান অন্য ইউনিয়নে হলেও আমার এলাকার লোকজন যদি এই ক্ষতি করে, তাহলে এর দায়িত্বটা আমার কাঁধেই পড়ে। এই ভেবে বিষয়টি নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার মধ্যেই আবারও বকাটেরা নোমানের বাগানের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি গাছ ভেঙ্গে এবং কেটে নষ্ট করে। নতুন করে আবারও ক্ষতি হওয়ায় বিষয়টি আর সম্ভব হয়নি। তবে, উদ্যোক্তা নোমান এর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো নয়। বিষয়টির উপযুক্ত ব্যবস্থা হওয়া দরকার। যেন বাগান মাালিক নোমান নিরাপদে কাজ করতে পারে এবং ভবিষ্যতে কিশোর বা বখাটেরা বাগানের আর কোন ক্ষতি করার সাহস না পায়।
কৃষক নোমান আলীর বাগানের ক্ষতিসাধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নিরাপদে ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমনটায় আশা ভূক্তভোগী কৃষক নোমান আলী ও স্থানীয় সচেতন মহলের।