চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল শিল্পের নাম-ডাক দেশজুড়ে থাকার পরও উপমহাদেশে এর বিস্তৃতি ছড়িয়ে ছিল। কাঁসা পিতলের জিনিসপত্র তৈরির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রামকৃষ্টপুর, শংকরবাটী, আজাইপুর ও রাজারামপুর এলাকা ছিল বিখ্যাত। এই কাঁসা শিল্পীরা নিপুন হাতে তৈরি করতেন থালা, বাটি, গ্লাস, কলস, গামলা, বড় হাঁড়ি বা তামাড়ী, চামচ, বালতি, ফুলদানী, কড়াই, হাঁড়িপাতিল, পিতলের ক্রেষ্ট, স্কুলের ঘন্টা, পানদানিসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী। এছাড়া কাঁসার থালায় ও ক্রেস্টের ওপর নিপুন হাতে তৈরি ঐতিহাসিক সোনামসজিদ, মহানন্দা ব্রীজ ও আম বাগানের মনোরম দৃশ্য সবার নজর কাড়ে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মোঘল শাসনামলে এদেশে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। প্রথমে তারা কাঁসা-পিতল দিয়ে ঢাল-তলোয়ারের প্রচলন শুরু করলে সৌখিন রাজা-বাদশাহরা কাঁসার বাসন- কোসনের ব্যবহার শুরু করে। তখন থেকেই এই শিল্পের ব্যবহার বেড়ে যায়, তৈরি হয় নতুন নতুন কারিগর।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা শিল্পের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু কালের আবর্তে কাঁসা পিতরের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং প্লাষ্টিক, মেলামাইন, ষ্টেইনলেস ষ্টিল ও কাঁচের সামগ্রী দামে কম ও সহজলভ্য হওয়ায় এখন কাঁসা-পিতলের সামগ্রী বেচা-কেনা কমে গেলেও বিয়ে, খাৎনা বা নতুন সন্তান জন্ম হলে এর কদর আজও রয়েছে। কারণ এই সব অনুষ্ঠানে এখনও কাঁসার, বাসন কোসন উপহার হিসেবে দেয়া হয়। তবে এখন মেলামাইন ও কাচের জিনিসপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং কাঁসা-পিতলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কাঁসার কারিগররা দুর্দিনের মধ্যে পড়লেও বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে জেলায় এখনো প্রায় ৩’শ কারিগর সক্রিয় রয়েছে। জেলা শহরের উপকণ্ঠে আজাইপুর, আরামবাগ, শব্জরবাটি ও রামকেষ্টপুর গ্রামের মানুষের এক সময় ঘুম ভাঙত হাতুড়ির শব্দে। ভোর থেকে সারাদিন ব্যস্ত থাকত ওই এলাকার মানুষ।
কাঁসার তৈরি জিনিসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়েন। তবুও অনেকে এই পেশা আকড়ে আছেন। তাদের ভাষায়, কাঁসা পিতলের কাজে শারীরিক পরিশ্রম খুব বেশি। সে তুলনায় মজুরি কম। এরপরও বাপ-দাদার পেশা হওয়ার কারণে এই পেশা ছাড়তে পারছেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প নতুন করে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। কাঁচামালের মূল্য এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এক সময় এই শিল্পে ধ্বস নামে। অন্যান্য শিল্পপণ্যের সঙ্গে কাঁসা-পিতল সামগ্রী প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। কিন্তু পণ্য তৈরিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল শিল্প নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এদিকে, মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আজও জেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে কাঁসার থালা-বাসনের ব্যবহার দেখা যায়।