ইচ্ছে শক্তিই মানুষকে অদম্য করে তোলে। ইচ্ছে শক্তির জোরেই মানুষ শতবাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সামনে এগোয়। এমনি জয় করেছে শত প্রতিকুলতাকে পেছনে ফেলে চল্লিশউর্ধ্ব মাঈনদ্দিন মানিকও। দারিদ্র্যতাকে পেছনে ঠেলে ইচ্ছে শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি’র গন্ডি ডিঙিয়ে ডিগ্রী ২য় বর্ষে লেখাপড়া করছেন মানিক। পেশায় ভ্যানচালক মাঈনুদ্দিন শুধু নাম নয়, দৃঢ়তার প্রতীক গ্রামবাসীর কাছে। জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত নাসিরাবাদ গুচ্ছগ্রাম। এ গ্রামে ৮০’র দশকে এরশাদ সরকার আমলে সরকারিভাবে করে দেয়া আবাসনে ঠাঁই নেন মাঈনুদ্দিনের নানী জোহুরা বেগম। তার বাড়িতেই বাবা আবদুল হামিদ ও মা কাঞ্চন বেগম বসবাস করতেন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মাঈনুদ্দিন বড়। বাবা আনসারের কাজের পাশাপাশি ছোট্ট চায়ের দোকান করতেন। সামান্য আয় দিয়েই চলত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংসার। টানাপড়ন ছিল নিত্যসঙ্গ মাঈনুদ্দিনের পরিবারে। ২৫ বছর আগের কথা। মাঈনুদ্দিন তখন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, বোন তৃতীয় শ্রেনীতে, আর ছোট ভাই তখনো স্কুলে যেতে শেখেনি। এ সময় মাঈনুদ্দিনের পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। সবাইকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে পরপারে পড়ি দেন বাবা আবদুল হামিদ। চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন মাঈনুদ্দিন। কী হবে সংসারের, কীভাবে চলবে সংসার, নিজের লেখাপড়ইবা করবে কীভাবে- এরকম হাজারো প্রশ্ন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশেষে পরিবারের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ভ্যানের প্যাডেলে পা রাখেন মাঈনুদ্দিন জীবিকার তাগিদে। সে থেকে আজও তার সঙ্গী ভ্যান। দারিদ্র্যতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সে কারণে ভ্যান চালিয়ে তাকে সংসার চালাতে হয়। বছর দুয়েক আগে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অটোভ্যানে রূপান্তর করতে হয়েছে তাকে। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়মিত চালিয়ে যেতে হয়েছে মাঈনুদ্দিন মানিককে। ভ্যান চালিয়ে বোনকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়ে দিয়ে দেন। ছোট ভাইকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের আগ্রহ না থাকায় পঞ্চম শ্রেনীর পর আর এগোয়নি। সেও আয় রোজগার করে এককভাবে বসবাস শুরু করে মাকে নিয়ে। এদিকে ২০ বছর পার হলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন সে। কিন্ত ক্লান্ত মাঈনুদ্দিন মানিক আবারও স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া করার। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে দুই মেয়ের বাবা মাঈনুদ্দিন ২০১৫ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। অংশ নেন এসএসসি পরীক্ষায়। ২০১৭ সালে এসএসসির ফল। জিপিএ ৩.২৫ পেয়ে পাশ করেছেন মাঈনুদ্দিন। এইচএসসিতে ভর্তি হন, সেখানেও জিপিএ ২.৫৫ পেয়ে পাস করেন ২০২১ সালে, তবে ভর্তি ও ফরমফিলাপ এর টাকা না থাকায় পা চালিত ভ্যানটি বিক্রয় করেন সে । নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি দুই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছেন তিনি। বড়মেয়ে ইয়াসমিন ১০ম শ্রেণীতে ও ছোট মেয়ে মরিয়ম ৮ম শ্রেনীতে পড়ছে। তার আশা, মেয়েরা যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। কিন্তু তার মেয়ে দুটিকে এ আশার মাঝে নিরাশা দোলা দেয়। তার কারণে। মেয়ে দুটিকে ভ্যান চালিয়ে কত দিন পারবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, এ প্রশ্ন পিতা হিসেবে তার নিজের কাছে। মাঈনুদ্দিনের এ সফলতায় গর্বিত তার গ্রামবাসী। গ্রামবাসী জানান, মনের জোর থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়। আর তাই অভাবও মাঈনুদ্দিনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
দেরিতে হলেও ইচ্ছে শক্তির কারণেই সে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করতে পেরেছে। মাঈনুদ্দিনের এ চেষ্টায় মুগ্ধ প্রতিবেশী মহিলা আনছার সদস্য জাহানারা বেগম। গ্রামের সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য দেলোয়ারা ও তার স্বামী মো. আবেদ আলী সাধুবাদ জানিয়েছেন তাকে। নাচোল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বাবু বলেন, মানিক ভ্যান চালিয়ে যে ভাবে লেখাপড়া করে এসএসসি ও এইচ এসসিপাস করে ডিগ্রীতে লেখাপড়া করছে, এটা আমাদের গর্ব। তাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করা হবে। নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) সহকারী শিক্ষক একরামুল হক বলেন, ভ্যান চালিয়ে এসএসসি পাশ করা আমার ছাত্র মইনুদ্দীন মানিক নাচোলের গর্ব ও এটি আমার চোখে দেখা প্রথম দৃষ্টান্ত।