আগের দিনগুলোতে প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘরে ঘরে থাকতো ২ একটা হ্যাচাক লাইট। বাড়িতে ছোট বড় কোন অনুষ্ঠান হলে সকাল বেলায় শুরু হত ঝাড়পোঁছ। তারপর সন্ধ্যে বেলায় তাকে জ্বালানোর প্রস্তুতি। যে কেউ এইটি জ্বালাতে পারতো না। সেরকম বিশেষ ব্যক্তিকে সেদিন পরম সমাদরে ডেকে আনা হতো। সেদিন তাঁর চাল-চলন থাকতো বেশ দেমাকি।বাড়ির কচি-কাচারা হ্যাচাক প্রজ্জ্বলনকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বসত। এরপর তিনি হ্যাচাকে তেল আছে কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে শুরু করতেন পাম্প করা। একবার একটা পিন দিয়ে বিশেষ পয়েন্টে খোঁচাখুঁচি করা হত। তারপর একটা হ্যাচাকের নব ঘুরিয়ে কিছু জ্বলন্ত কাগজ তার সংস্পর্শে আনতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠত। তখন শুরু হত আচ্ছা করে পাম্প দেওয়া। ক্রমেই হ্যাচাকের মাঝখানের ম্যান্টেল থেকে বেশ উজ্জ্বল আলো বেরনো শুরু হত। সেই সঙ্গে একটা বুকে কাপঁন ধরানো হিসসসসস আওয়াজ হত। আবার মাঝে মাঝে হ্যাচাকের ওপর দিয়ে দুম করে আগুন জ্বলে উঠত। আবার কখনও বা গোটাটাই নিভিয়ে যেত। সফলভাবে হ্যাচাক জ্বালানোর পর সেই ব্যক্তির মুখে ফুটে উঠত এক পরিতৃপ্তির হাসি। আর হ্যাচাকের সেই উজ্জ্বল জাদুর আলোয় কচিকাচারা চলে যেত এক আনন্দের জগতে। গ্রাম-বাংলা থেকে ত্রুমেই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীনতম আলোর সরঞ্জাম হ্যাচাক লাইট। বিয়ে-শাদি, পূজা -পার্বণ, যাত্রাপালা, এমন কি ধর্ম সভায়ও ভাড়া দেওয়া হত এই হ্যাচাক লাইট। হ্যাচাক দেখতে অনেকটা হ্যারিকেনের মতোই কিন্তু আকারে বেশ বড়। আর প্রযুক্তিও ভিন্ন রকম। জ্বলে পাম্প করে চালানো সাদা কেরোসিনের কুকারের মতো একই প্রযুক্তিতে। চুলার বার্নারের বদলে এতে আছে ঝুলন্ত একটা সলতে। যেটা দেখতে প্রায় ১০০ ওয়াটের সাদা টাংস্টেন বাল্বের মতো। এটি অ্যাজবেস্টরে তৈরি। এটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায় না। পাম্প করা তেল একটা নলের ভিতর দিয়ে গিয়ে স্প্রে করে ভিজিয়ে দেয় সলতেটা। বাতি এক প্রকার সরঞ্জাম। বাতির ব্যবহার অতি প্রাচীন। সাধারণত বাতি বলতে বুঝায় কুপি, টর্চ লাইট, হ্যারিকেন ও হ্যাচাক। বাতি হল সেই সরঞ্জাম যা অন্ধাকার দূর করতে ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকালে আগুনের ব্যবহারের মাধ্যমে বাতির প্রচলন হয়। প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সবখানেই। ফিলামেন্ট বাতির বদলে এলইডি বাতির চলনও নতুন নয়। তবে এলইডির সঙ্গেও এখন যুক্ত হয়েছে নানা রকম প্রযুক্তির বাতিও হয়েছে স্মার্ট। বাজার ঘুরে দেখা গেছে- বাসা-বাড়ি, অফিস, কারখানার নানারকম বাতির খোঁজ। হ্যাচাক লাইট মেরামতকারি রমেশ চন্দ্র দাস এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ২০ বছর আগে হ্যাচাকের ব্যবহার যথেষ্টো ছিল। তখন হ্যাচাক লাইট ঠিক করে আয় ভাল হত। দিনে ৪-৫টি করে মেরামত করে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করতাম। কিন্তু বর্তমানে হ্যাচাক লাইট নেই বললেই চলে। তাই এখন পেশা পরিবর্তন করে বাইসাইকেল, রিক্সা ভ্যান এর মেরামতের কাজ করি। হ্যাচাক লাইট: বানার কাজ হচ্ছে তেল সাপলাই দেওয়া, পিন: তেল বন্ধ করা এবং খোলা, মাটিরছিদ্র, ভেপার: তেল সাপলাই দিয়ে ম্যান্ডলে দেয়, ম্যাকজিনে ম্যান্ডল বাধা হয়, ম্যাকজিন তেল সাপলাই দেয়, চেমি/কাইচের কাজ হচ্ছে আলো বৃদ্ধি করা এবং হাড়িতে তেল ধরে ১.৫০০ কেজি। এই তেল দিয়ে প্রায় সারা রাত চলে যায়। ১২৫ টাকা করে ভাড়া দেওয়া হত প্রায় ৪০ বছর আগে। জ্যৈষ্ঠ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত এই ১০ মাস মাছ শিকারের জন্য হ্যাজাক লাইট ব্যবহার করতেন আব্দুল্লাহ। গ্রাম-বাংলায় বিদ্যুৎ চলে আসার পর থেকে হ্যাচাকের কদর তেমন নেই। এভাবে কালের পরিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে একসময়ের জনপ্রিয় প্রাচীনতম আলোর উৎস হ্যাজাক লাইট।